আরিফুল ইসলাম
ফরাসি কাঠামোবাদী মার্কসবাদী দার্শনিক লুই আলথুসার, তার সমসাময়িকদের মধ্যে ইতালীয় দার্শনিক আন্তনিয় গ্রামসি প্রণিধানযোগ্য। তার শিক্ষার্থীর ফর্দ করতে গেলে উঠে আসবে অনেক বিখ্যাতজনের নাম। যার মধ্যে মিশের ফুকো, জাক দেরিদা এবং চে গুয়েভারার সাথে বলিভিয়ার প্রান্তরে লড়াই করা রেজি দেব্রের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।
প্রথিতযশা এই দার্শনিক ছিলেন স্লিপওয়াকর। রাতেরবেলা অবচেতন মনে হেটে বেড়াতেন এ ঘর থেকে ও ঘর কিন্তু সকালবেলা এবিষয়ে কিছুই বলতে পারতেন না তিনি। বিশ্বনন্দিত এমন একজন দার্শনিকের এমন কান্ড অবাক করে সবাইকে।
তবে, আলথুসার সম্পর্কে সবথেকে অাশ্চর্যজনক তথ্য হলো তিনি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তার স্ত্রী সমাজতত্ত্ববিদ হেলেন রাইটমানকে গলা টিপে হত্যা করেন। ঠিক কি কারণে আলথুসার হেলেনকে মেরেছিলেন, তা এখনো অজানা। এমনকি এবিষয়ে আলথুসারের লেখা সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার আত্নজীবনীমূলক স্মৃতিচারণা গ্রন্থ ‘দ্য ফিউচার লাস্টস ফরএভারে ও নেই বোধগম্য কোনো বিশ্লেষণ। এবং ঠিক এ কারণেই আলথুসারের স্ত্রী হত্যা প্রসঙ্গ হালের দিনগুলিতেও ভাবায় মানবসভ্যতাকে। বিশেষত, রেজি দেব্রে কিংবা জাঁ গিতঁর মতো দার্শনিকেরা যখন বলেন, এ হত্যা ছিলো আলথুসারের তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এ এক নজির বিহীন প্রণয়। তবে, তার বন্ধু ডগলাস জনসনের দাবি, আলথুসারের স্লিপওয়াকিং রোগের কারণেই ঘুমের ঘোরে হত্যা করেছেন হেলেন রাইটমানকে।
এই দার্শনিকের প্রধানতম তত্ত্ব হলো অাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারণা। তার মতে,রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যান্য মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে কেবলই দমন-পীড়ন মূলক এক সত্তাকে বুঝিয়েছেন। তিনি এখানে বিরোধ পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু দমনমূলক-ই হয় না অাদর্শিকও হতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্রকে তিনি দুইভাগে ভাগ করছেন;
(১) দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র বা রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস
(২)অাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র বা ইডিয়োলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস।
দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংক্ষেপে আরএসএ(RSA) এবং অাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে আইএসএ (ISA) বলা যেতে পারে।
দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের- যেমন অাদালত,পুলিশ, অার্মি-কাজ হলো সহিংস পথে সব ঠিক রাখা।তবে সহিংস না হয়েও চাপ দিয়ে কিংবা ভীতি প্রদর্শন করেও কার্যসিদ্ধি করা যেতে পারে। এই আরএসএর তিনটি ভাগ রয়েছে :
প্রথমে পুলিশি চাপ, জেলে পোরা এবং সর্বশেষ, সামরিক বাহিনী মাঠে নামানো। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অাইএসএ গুলোর কাজ হচ্ছে সহিংস দমন-পীড়নের দিকে না যেয়ে বরং ক্ষমতায় যারা আছে তারা যা যা বিশ্বাস করে, সেসব কিছুকে রাষ্ট্রীয় আদর্শরুপে প্রচার করতে থাকা। আলথুসার বলছেন, আইএসএ গুলো সিভিল সোসাইটির অংশ। এদেরকে দেখতে মনে হয় অরাজনৈতিক তবে এরা ভয়াবহ সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,নাটক-সিনেমা, সংবাদপত্র-টিভির মতো সব মিডিয়া প্রতিষ্ঠান,সাহিত্য নামের আপাত-অদৃশ্য প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির-চার্চ-মাদ্রাসা জাতীয় সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মোহামেডান ক্লাব-আবাহনী ক্লাবের মতো সব সোশ্যাল ও স্পোর্টস ক্লাব আর ফ্যামিলি-পরিবার। এরা হলো রাষ্ট্রের ইডিয়োলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা শাসকের আইডিয়োলজি প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রযন্ত্র।
অালথুসার বলেছেন, রাষ্ট্রের দেখতে নিরীহ কিন্তু ‘কন্টিনিউয়াস সাইকোসোশ্যাল’ প্রক্রিয়ায় অামাদের মাথা নষ্ট করতে থাকা আইএসএ গুলোর মাধ্যমে সরকার যদি আইএসএ গুলোকে বশ না করে রাখে আর আইএসএ গুলো দিয়ে আমাদের বশীভূত করে না রাখে তবে কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো সামাজিক গোষ্ঠী-ই তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারবেনা।
আইএসএ গুলো ব্যার্থ হলে সরকার স্রেফ পুলিশ,গোয়েন্দা, আর্মির অারএসএ দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেনা।