বিচারপতি ওবায়দুল হাসান
শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং হুমায়ূন আহমেদের ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন হলেও তারা উভয়ই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তারা দুজনই বাংলার শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশে কাজ করে গেছেন জীবনভর। শুধু সময়ের ব্যবধান ছিল অর্ধ শতাব্দী। একজন মানুষের প্রয়াণেই তার সব কীর্র্তি হারিয়ে যায় না…
চলমান বৈশ্বিক করোনা মহামারীতেও কিছুু কিছুু ভাবনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছি না। ফেলে আসা দিন, প্রিয় শ্রদ্ধেয় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির চর্চিত জীবন ও তাদের অনুশীলিত দর্শন মনের মাঝে ঘুরে ফেরে। জুলাই মাসের ১৯ তারিখ, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ শান্তি নিকেতনের সংগীত ভবনের সাবেক অধ্যক্ষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মদিন। এবছর তার একশ কুড়িতম জন্মদিন। আবার এ দিনটিতেই উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের তিরোধান দিবস বা তার মৃত্যুবার্ষিকী। এদের দুজনকে নিয়েই কিছু কথার গুচ্ছে সাজানো আমার আজকের এ লেখা। তারা দুজনই ছিলেন আমার বা আমাদের অর্থাৎ আমরা যারা নেত্রকোনাবাসী তাদের আত্মার পরম আত্মীয়। একজন ছিলেন আমাদের বাবা কাকা বা তাদেরও কিছু আগের সময়ের আর একজন একালের কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই তদানীন্তন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশনের পর ভর্তি হন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে। সম্ভবত ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেন। এরপর কিছুদিন তিনি কলকাতাস্থ আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯২৭ সালে শৈলজারঞ্জন মজুমদার আইন শাস্ত্রে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার ইচ্ছায় তিনি ওকালতির সনদ নিয়েছিলেন বটে তবে এ পেশায় নিবিষ্ট হননি। তিনি চাননি এ পেশায় যুক্ত হতে।
শৈলজারঞ্জন মজুমদারের চারজন জ্ঞাতি কাকা শান্তিনিকেতনে পড়ালেখা করতেন। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে ফেরার পথে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নেত্রকোনার বাসায় তারা রাত কাটাতেন। এদের বেশভুষা চলাফেরা কথা বার্তা কিশোর শৈলজারঞ্জনের কাছে একটু অন্যরকম লাগতো। তারা ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। কলকাতার শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তারা গুরুদেব বলে সম্বোধন করতেন। কবিগুরুর প্রতি তাদের এমন বিনীত শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে শৈলজারঞ্জন তার কৈশোর থেকেই শান্তি নিকেতন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হন। আর তার এ আকর্ষণ ছিল কবিগুরুকে জানার ও তার সান্নিধ্যের প্রত্যাশায়। ক্রমেই এ আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ১৯২১ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে শৈলজারঞ্জন প্রথম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখেন। সেদিনের এক বর্ষা মঙ্গল অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন- ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ কবিতাটি।
কবিগুরুকে সেই প্রথম দেখার পর থেকেই শৈলজারঞ্জন মজুমদার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। এভাবে একদিন ঠাকুরবাড়িতে শৈলজারঞ্জনের সঙ্গে পরিচয় হয় কবিগুরুর। দিন গড়াতে থাকে। এরপর ১৯৩২ সালের মাঝামাঝি সময়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদার শান্তি নিকেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের বিশ্বভারতীতে যোগদানের ব্যাপারে দ্বীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৩২ সালে ১ জুলাই শৈলজারঞ্জন বিশ্বভারতীতে যোগদান করেন।
কিন্তু কেন যেন বাবা রমণী কিশোর দত্ত পুত্রের শান্তি নিকেতনে যোগদান ভালোভাবে নিতে পারেননি। তার ধারণা ছিল রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে তার সন্তানের অর্থ কষ্ট হতে পারে। এটি ভেবে ১৯৩২ সালের আগস্ট/সেপ্টে¤¦র মাসে লোক মারফত তিনি ছেলের কাছে ৩০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন। শৈলজারঞ্জনের বাবা বাহককে বলেছিলেন সে যেন তার ছেলেকে বলে প্রেরিত এ টাকা ব্যাংকে রাখতে। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে খরচ করবে। শৈলজারঞ্জন মজুমদার ক্রমেই কবিগুরুর কাছাকাছি আসতে থাকনে। বন্ধন সৃষ্টি হয় দুজনের মাঝে। কবিগুরুও চিনতে পারেন শৈলজারঞ্জনের মনোজগতকে। এভাবেই ১৯৩৯ সালে শৈলজারঞ্জনকে কবিগুরু বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। এ প্রাপ্তি ছিল কবিগুরুর অপার স্নেহাবৃত। এভাবে শৈলজারঞ্জন ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দুজনই এক মধুর সম্পর্কে জড়িয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথ একদিন শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে জিজ্ঞেস করলেন-‘কেউ যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি শান্তি নিকেতনে কী কর? তবে কী বলবে?’ শৈলজারঞ্জন বললেন, ‘আমি অধ্যাপনা করি এ কথাই বলব।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘অধ্যাপনা কর কি বিষয়ে বলবে?’ শৈলজারঞ্জন বললেন, ‘কেন কেমিস্ট্রি?’ তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘না না দুটো মিশিয়ে বলবে।’ শৈলজারঞ্জন জানতে চাইলেন-‘কার সঙ্গে কি মেশাব?’ রবীন্দ্রনাথ বললেল, ‘হয় কেমিক্যাল মিউজিক নয়তো বলবে মিউজিক্যাল কেমিস্ট্রি।’ আমার মনে হয় দুজনের এমন বচন বিনিময়ে রসবোধ থাকলেও এর মাঝে একটা বার্তা ছিল।
নেত্রকোনার একজন মানুষ হিসেবে এটি বলতে গর্ব হচ্ছে যে, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের উদ্যোগে ১৯৩৫ সালে শান্তি নিকেতন বা কলকাতার বাইরে নেত্রকোনাতেই প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়েছিল। এ জয়ন্তীর একক উদ্যোক্তা ও সংগঠক ছিলেন বাবু শৈলজারঞ্জন মজুমদার। এখন তো প্রতি বছর সারা বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতে এমনকি পৃথিবীর বহু দেশেই রবীন্দ্রজয়ন্তী নিয়মিতভাবে পালিত হয়ে থাকে। শান্তি নিকেতনের বাইরে নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের খবরে বেশ খুশি হতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছ থেকে পালিত উৎসবের কথা জানতে চাইতেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কখনো নেত্রকোনায় আসেননি। তবে ময়মনসিংহে এসেছিলেন। আঠার বাড়ি পর্যন্ত সফর করেছেন আঠার বাড়ির জমিদারদের আমন্ত্রণে। তার কথা ও কাজের মাঝে খুঁজে পেয়েছি নেত্রকোনার প্রতি গভীর এক টান। নেত্রকোনা নামটির প্রতি কবিগুরু হৃদয়ের টান সৃষ্টিতে স্থপতির কাজ করেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। আগেই উল্লেখ করেছি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নেত্রকোনা সম্পর্কে নানা খোঁজখবর নিতেন শৈলজারঞ্জনের কাছ থেকেই। এ যেন ছিল এক মায়ার টান! নেত্রকোনার মগরা নদীর নাম জানতেন তিনি। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে মাঝে মধ্যে কবিগুরু জিজ্ঞেস করতেনÑ ‘তোমাদের নদীটির নাম যেন কী?’ উত্তরে শৈলজারঞ্জন যখন নদীটির নাম বলতেন ‘মগরা’ তখন কবিগুরু মগরা শব্দের অর্থ জানতে চাইতেন। ‘মগরা’ শব্দের অর্থ যে ‘রাগি’, এটি বলার পর কবিগুরু গ্রামীণ মানুষের শব্দ বানানোর ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। ‘নেত্রকোনা’ এই নামটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে গেঁথে গিয়েছিল। এর বহু প্রমাণ আমরা তার সাহিত্যে ও চিঠিপত্রে দেখতে পাই। তিনি তার পত্র সাহিত্যে নেত্রকোনার কথা এমনভাবে উল্লেখ করেছেন যা দেখে মনে হয় কবিগুরু কোনো না কোনো সময় নেত্রকোনায় বাস করেছেন। নেত্রকোনা যেন তার আরেকটি নিবাসস্থল।
শান্তি নিকেতনের একজন কর্মকর্তা প্রশান্ত মহলানবিশ ও তার স্ত্রী নির্মল কুমারী মহলানবিশ (রানী) রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে এদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। যে বাড়িটিতে মহলানবিশ দম্পতি বাস করতেন সেটির নাম ছিল ‘শশী ভিলা’। রবীন্দ্রনাথ এ বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ঘরটির নাম রেখেছিলেন নেত্রকোনা। ১৯৩৬ সালের প্রকাশিত ‘শ্যামলী’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন নির্মল কুমার মহলানবিশকে। ওই গ্রন্থের ভূমিকায় কবিগুরু নেত্রকোনাকে তুলে ধরেছেন এভাবে। নেত্রকোনার সঙ্গে কবিগুরুর গল্পগুলো খন্ড খন্ড। কিন্তু তা ছিল তার জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। তার ওই গল্পগুলো এখনো মিশে আছে নেত্রকেনার মাটিতে আলো বাতাসে।
জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে
আমের শাখায় আঁখি ধেয়ে যায় সোনার রসের আঁশে।
লিচু ভরে যায় ফলে,
বাদুড়ের সঙ্গে দিনে আর রাতে অতিথির ভাগ চলে।
বেড়ার ওপারে মৌসুমি ফুলে রঙের স্বপ্ন বোনা,
চেয়ে দেখে দেখে জানালার নাম রেখেছি ‘নেত্রকোনা’।
কবিগুরুর মনে নেত্রকোনার প্রতি যে আকর্ষণ দৃশ্যমান সেটি মূলত শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে তার গড়ে ওঠা বন্ধনের কারণেই। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে শান্তি নিকেতন ডিলিট উপাধি দিয়েছিল। সে জন্য কোথাও কোথাও শৈলজারঞ্জনের নাম ড. শৈলজারঞ্জন মজুমদার লেখা হয়ে থাকে।
মনে পড়ছে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে উদ্যাপিত হয়েছিল শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ১১২তম জন্মদিন। অনুষ্ঠানটিতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রধান অতিথি হিসেবে। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আমাদের নেত্রকোনার আরেক কৃতী পুরুষ বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ। এ অনুষ্ঠানে পশ্চিম বাংলা থেকেও বেশ কয়েজজন গুণী ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। তারা সবাই রবীন্দ্রনাথ ও শৈলজারঞ্জনের অকৃত্রিম ভক্ত। তারা হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্যামল চক্রবর্তী, লেখক ও গবেষক ড. সোমা সেন, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নন্দিনী মুখার্জী, শিক্ষক ও সংগীত শিল্পী ড. পুতুল চক্রবর্তী। সে সময় তারা সবাই নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে আমাদের বাড়ি ‘ছায়ানীড়ে’ অবস্থান করেছিলেন। অনেক কথা বিনিময় হয় তাদের সঙ্গে।
সেদিনের সেই অনুষ্ঠান চলাকালীন নির্মলেন্দু গুণ বিষণœœ কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, ‘আজকেই হয়তো আমাদের একটা দুঃসংবাদ শুনতে হবে’। চমকে গেলাম। আমি তার কাছে জানতে চাই দুঃসংবাদটি কী হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘সম্ভবত প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আর বেঁচে নেই। তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।’ মনে বিষাদের ছায়া নামল। সকালের অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা সবাই একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারি। বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলে আমি কিছুক্ষণ অবস্থান করে বাসায় চলে আসি। বেশ রাত অবধি অনুষ্ঠানটি চলছিল। হঠাৎ রাত ১০:৩০ অথবা ১০:৪৫ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে খবর আসে ‘হুমায়ূন আহমেদ আর নেই’। এ দুঃসংবাদটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত আয়োজকরা তাৎক্ষণিকভাবেই শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। শ্রদ্ধা জানান জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণে।
একালের কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক ও কথাসহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভে¤¦র নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের দৌলতপুরে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। হুমায়ূন আহমেদের জন্মস্থান এবং আমাদের বাড়ির মধ্যে দূরত্ব ৫০০ গজের মতো হবে। হুমায়ূন আহমেদের মামারা আমাদের প্রতিবেশী। বয়সে হুমায়ূন আহমেদ আমার চেয়ে ১১/১২ বছরের বড় ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে বিএসসি অনার্সসহ এমএসসি পাস করেন ১৯৭৩ সালে। ১৯৮২ সালে পি.এইচডি এবং ১৯৮৩ সালে পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশিপ করেন আমেরিকা থেকে। তার লেখা জনপ্রিয় উপন্যাসের সংখ্যা অগণিত। তার প্রখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, তোমাদের জন্য ভালবাসা, ফেরা, মাতাল হাওয়া, অপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। তরুণ পাঠকদের কাছে তিনি ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরদিন আমি ঢাকায় চলে আসি। পরে হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সঙ্গে তাদের মিরপুরের পল্লবীর বাসায় সাক্ষাৎ করি। গভীর সমবেদনা জানাই।
যারা ভারত থেকে শৈলজারঞ্জনের ওই জন্মবার্র্ষিকীতে এসেছিলেন তাদের প্রত্যেকেই রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন। কাকতালীয়ভাবে শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং হুমায়ূন আহমেদ দুজনই পড়াশোনা করেছেন রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে। দুজনেরই দৃশ্যমান বন্ধন ছিল নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের সঙ্গে। তারা দুজনই একই জেলার আধিবাসী এবং একই থানা এলাকা তাদের জন্মস্থান। উভয়েই রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন। একজন ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরজন ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি করেছেন। শুধু ৪৯ বছর সময়ের তফাৎ। হুমায়ূন আহমেদের পৈতৃক নিবাসও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে।
আমার মনে পড়ে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতবর্ষের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য পশ্চিম বাংলা, আসাম ও আগরতলার অনেকাংশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। প্রখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল’। ২০১২-এর ১৯ জুলাই যে অনুষ্ঠানটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম সে অনুষ্ঠানটি ছিল প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় একজনের জন্মদিন পালনের উৎসব। আর ওই দিনটিই আমাদের জন্য একটি শোকের দিনে পরিণত হয়ে গেল! কী কাকতালীয় ব্যাপার। দুটি মানুষই একই অঞ্চলের। দুটি মানুষই নেত্রকোনার, যে নেত্রকোনা কবিগুরুর হৃদয় স্পর্শ করেছিল। কবিগুরুর হৃদয়ে করে নিয়েছিল জায়গা। আরও কাকতালীয় ব্যাপার এই যে, সেদিন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ওপার বাংলা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে যারা এসেছিলেন তারা সবাই ছিলেন সেই রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক। আর এ রাসয়ন শাস্ত্র নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে বলেছিলেন, রসায়ন শাস্ত্রকে ‘হয় কেমিক্যাল মিউজিক নয়তো বলবে মিউজিক্যাল কেমিস্ট্রি’।
শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়েছিল। মনে আছে তিনি একবার বাংলাদেশে এসে মোহনগঞ্জে আমাদের বাসায় আমার বাবার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। আর হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল। ঢাকা নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারে। আমরা কিছুক্ষণ উভয়েই দাঁড়িয়ে মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন স্মৃতির কথা আলাপ করছিলাম। মোহনগঞ্জ তথা নেত্রকোনার মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল শৈলজারঞ্জন মুজমদারের বাড়িটি যেন উদ্ধার করে তা সংরক্ষণ করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে এবং সংগীতপ্রিয় মানুষদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছিলাম।
সম্প্রতি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মৃতি রক্ষার জন্য তার পৈতৃক ভিটায় শৈলজারঞ্জন সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ স্থাপনাটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সচিব আমার ছোট ভাই সাজ্জাদুল হাসানের (সিনিয়র সচিব) ভূমিকাই মুখ্য। আমরা নেত্রকোনাবাসী সরকারের কাছে আজ আরও একটি দাবি জানাতে চাই- সরকার যেন উপমহাদেশ খ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নামেও নেত্রকোনায় একটি স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। দুটো উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ যেমন শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে জানতে পারবে ঠিক তেমনিভাবে আরও বেশি করে জানতে পারবে প্রখ্যাত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকেও।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং হুমায়ূন আহমেদের ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন হলেও তারা উভয়ই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তারা দুজনই বাংলার শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশে কাজ করে গেছেন জীবনভর। শুধু সময়ের ব্যবধান ছিল অর্ধ শতাব্দী। একজন মানুষের প্রয়াণেই তার সব কীর্র্তি হারিয়ে যায় না। শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে রইবেন তাদের কর্ম ও কীর্তির মাঝে। আজ ২০২০-এর ১৯ জুলাই শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মদিবস ও হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিবসে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি তাদের দুজনকে। এ দুই মহামানবের আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।