পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এই দিনটিতে সামর্থ্যবান মুসলমানরা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য পশু কোরবানি করেন। অত্যন্ত আনন্দ, উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় দিনটি। কিন্তু এবার সে পরিস্থিতি নেই। করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ। গত চার মাসে করোনা, সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, কালবৈশাখীর ঝড়, অতিবৃষ্টি ও সর্বশেষ বন্যায় মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষকের ফসল নষ্ট হয়েছে, ব্যবসায়ীর ব্যবসা নেই। চাকরি হারিয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা, অনেকের বেতন কমেছে।
এসব কারণে এবার কোরবানির সংখ্যা কমতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা গতবছর কোরবানিতে পশু জবাই করা হয়েছিল এক কোটি ৬ লাখ। গতবারের তুলনায় এবার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গবাদিপশু কম বিক্রি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ক্রেতাদের হাতে টাকা নেই। অন্যদিকে করোনা মহামারিজনিত অবস্থার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, যেহেতু দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ অভাবে আছেন। এমতাবস্থায় কোরবানি না করে তার অর্থ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হোক। কিন্তু ইসলামি শরিয়তে এর কোনো অনুমোদন নেই, এর কোনো সুযোগ নেই।
তবে হ্যাঁ, যারা অন্য বছরগুলোতে বেশি পরিমাণে কোরবানি করতেন এবার তা না করে সেই অতিরিক্ত কোরবানির টাকা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারেন, এই সুযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ভারপ্রাপ্ত খতিব, সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান বলেন, কিছু দিন থেকে আমরা শুনছি বিভিন্ন মিডিয়াতে কিছু আলোচনাও হচ্ছে যে, পশু কোরবানি এই পরিস্থিতিতে কতটুকু সম্ভব? করা যাবে কি যাবে না? নাকি কোনো বিকল্প কিছু করা যাবে? অনেকে এটাও বলছেন যে, কোরবানি না করে অর্থ গরিবদের দিয়ে দিলেতো আরও ভালো হয়- এরকম চিন্তাভাবনার কথা কেউ কেউ পেশ বলছেন। আসলে এখানে শরিয়ত কী বলেছে? ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করা একটি সুনির্দিষ্ট ইবাদত ও বিধান। এটি পালন করতে হয় নির্দিষ্ট সময় ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে। এটা ওয়াজিব বিধান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
তিনি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোরবানি জিনিসটা কী? জবাবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এটা হচ্ছে তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এ গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব বিধানটি অবশ্যই আমরা পালন করব। যার ওয়াজিব তাকেই এটি পালন করতে হবে। জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত এই তিন দিন যে ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার যেকোনো একটির সমপরিমাণ সম্পত্তি) তার জন্য গরু, মহিষ, উট এগুলোর একটা অংশ অথবা ছাগল, দুম্বা এসব পশুর একটি কোরবানি করা ওয়াজিব। ভারপ্রাপ্ত খতিব বলেন, অন্য সময়ে যারা বেশি পরিমাণে কোরবানি করতেন, বেশি টাকা দিয়ে পশু কিনতেন- এবার তা না করে অতিরিক্ত অর্থ বিলিয়ে দিতে পারেন।
কোরবানির সময় এটাও খেয়াল রাখতে হবে, কোরবানির পশুর গোশত ও চামড়ায় গরিবের হক রয়েছে। চামড়ার ন্যায্য মূল্য থেকে গরিবরা যেন বঞ্চিত হয়ে না যায়- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এখন করোনা চলছে। এ সময়ে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কোরবানির হাটে ও কোরবানির সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সরকারিভাবে কোরবানির জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হলে; শৃঙ্খলার জন্য, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার জন্য নির্দেশ দিলে সেটাও মেনে চলা উচিত। বাজার বিশ্লেষণসহ নানা প্রেক্ষাপটে অন্য বছরগুলোর তুলনায় কোরবানির সংখ্যা এবার কম হবে- এটা অনেকটা নিশ্চিত।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিবছর যেখানে একজন একাই কয়েকটি পশু কোরবানি দিতেন তিনি এবার একটি, অন্যদিকে যারা একটি পশু কোরবানি দিতেন এবার শেয়ারে দেবেন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কোরবানি চলবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে প্রতিবছরের মতো স্বাভাবিক হবে না। কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরআন-হাদিসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর প্রতি বছর কোরবানি করেছেন। তিনি কখনও কোরবানি পরিত্যাগ করেননি, বরং কোরবানি পরিত্যাগকারীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে।’ ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে যেসব প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক, মুকিম ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে অর্থাৎ স্বীয় হাজাতে আসলিয়্যাহ (পানাহার, বাসস্থান, উপার্জনের উপকরণ ইত্যাদি) ছাড়া অতিরিক্ত এ পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, যা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্যের সমপরিমাণ (টাকার অংকে আনুমানিক ৫৫ হাজার টাকা) হয়, ওই ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছেদ, আসবাবপত্র, তৈজসপত্রও ধর্তব্য হবে। সে সম্পদের ওপর এক বছর অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। পাগলের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেও তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না। মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। মুসাফির ব্যক্তি কোরবানির দিনগুলো অতিবাহিত হওয়ার পর যদি বাড়ি ফিরে আসে, তাহলেও তার ওপর কোরবানির কাজা করা লাগবে না। -ফাতাওয়া কাজিখান: ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯৪ উল্লেখ্য, ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করে তাকে মুসাফির বলা হয়।
প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করা ওয়াজিব। তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, সে কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করলে সে পশু কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব, সে যদি কোনো কারণবশত কোরবানি না করে, তাহলে কোরবানির দিনগুলো চলে যাওয়ার পর একটি বকরির মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।