“রমিজ ;কি মা,কি হয়ছে? বাবা শোন তোর বাপের তো অসুখ ছাড়ছে না। এদিকে কিস্তিও শুরু হইবো..কোনো উপায় তো দেখছি না। কাজ-কর্ম নাই কিস্তি চালামো কি করে?আবার কিস্তি না দিলেও কত ডর ,ভয় দেখায় অফিসারেরা।
এমনটাই ছেলের সাথে বলছিলেন রমিজের ‘মা নূরজাহান বেগম। রমিজ কৃষক পরিবারের সন্তান ,পড়াশোনায় অনেক ভালো। কষ্টের ফল হিসেবে রমিজ দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সও পেয়েছে। পরিবারে রমিজসহ আরো তিন ভাই-বোন রয়েছে। তাদের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হলো তার বাবা। বেশ কিছু দিন যাবত রমিজের বাবা নানা রকম অসুখে ভুগছে। একদিকে সাংসারিক খরচ অন্য দিকে ছেলের পড়াশোনার খরচ ,তার ওপর প্রতি সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করা। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।
এর কয়েক দিন পরের ঘটনা। দিনটা ছিল মঙ্গলবার । যথারীতি টাকা উত্তোলনের জন্য কেন্দ্রে উপস্হিত এনজিওর মাঠকর্মী। রমিজের বাবার অসুখ তখনও কমেনি। মানুষটার শরীরে কাপুনী দিয়ে জ্বর আসে,ঔষুধ কেনার মতো টাকা নাই। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় রমিজও বাড়িতে কয়েকদিন যাবত। সকালে খাবার হিসেবে খেয়েছে রাতে থেকে যাওয়া পান্তা ভাত। রমিজের মা চিন্তায় আছে কখন ঘরের দরজায় এসে দাড়িয়ে যায় এনজিওকর্মী। যেমন চিন্তা তেমনটাই হলো।
বাইরে থেকে এনজিওকর্মীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ,নূরজাহান আপা,অ নূরজাহান আপা। ওপাশ থেকে রমিজের মা বলে আসছি ,স্যার।নূরজাহান বেগম ঘর থেকে বের হতেই ,আপনার জন্য আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো?টাকা দেন। আমার আবার অন্য জায়গায় যেতে হবে। নূরজাহান বেগম:স্যার ,ঘরে ছেলের বাবা অসুস্হ অনেক দিন হলো। সংসারে আয়,রোজগার নাই। খাবার-ই খাইতে পারছি না ছেলে -মেয়েকে নিয়ে। এই সপ্তাহের টাকাটা সামনের সপ্তাহে দিলে হবে ?স্যার। এনজিওকর্মী:টাকা আনার সময় এই সব কথা কোথায় থাকে?তখন তো ঘরে কেউ অসুস্হ থাকে না। টাকা ফেরত দিতে গেলে যত কাহিনী শুনতে হয়। আমি টাকা নিতে আসছি,টাকা দেন। আমার আবার অফিসে গিয়ে বুঝ দিতে হবে । টাকা সামনের সপ্তাহ দেয়ার কোনো নিয়ম নাই। এভাবেই আচরন শুরু করেন এনজিওকর্মী। মানুষটার ভেতর মানবিকতাও কাজ করল না। শেষে বিকেল পর্যন্ত সময় দেন ,বিকেলের মধ্যে যেন অফিসে টাকা পৌছে যাই। এই কথা বলে চলে যান।
নূরজাহান বেগম কোনো উপায় না দেখে ঘরে থাকা চাল বিক্রি করেন । চালেরও প্রকৃত দাম পাইনি। অল্প দামে বিক্রি করে অফিসে বিকেলের আগে টাকা দিয়ে আসেন।
এভাবেই প্রতিটা সপ্তাহ পার করতে হয় নূরজাহান বেগমের মতো হাজারো নারীর। তাদের মধ্যে রমিজদের পরিবার থেকে আরো খারাপ অবস্হার পরিবারও রয়েছে।
করোনাকালীন সময়ে আরো বেশি কষ্টে পার করছে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো। একদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুভয় অন্য দিকে না খেয়ে মরার ভয়।করোনার কারনে দুই মাস সব ধরনের এনজিও বন্ধ ছিল। গত ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউন খুলে দেয়ার পর এনজিওগুলোও তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের তাগাদা দিচ্ছেন। কর্মহীন, সংসার চালাতে ব্যর্থ হওয়া এসব মানুষগুলোর টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে অনেকটা বাধ্য হয়ে। না হয় আগামী বছর টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। যে টাকার ওপর নির্ভর করে যাদের অনেক বড় বড় স্বপ্ন।করোনাকালীন সময়ে অনেকের পরিবার অনাহার,অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে,একদিকে তাদের সংসার চালানোর চিন্তা অন্যদিকে এনজিওর টাকা পরিশোধ করার চিন্তা। দুই চিন্তা এক হয়ে তাদের বুকে আঘাত করে। তারা না পাচ্ছে কোনো কাজের হদিস ,না পারছে কিস্তি পরিশোধ করতে।
লকডাউন থাকা অবস্থায় এই সমিতিগুলো বন্ধ ছিল,সাথে বন্ধ ছিল বিদ্যুত বিল। কিন্তু লকডাউন খুলে দেয়ার সাথে সাথে সকল বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে বিদ্যুত বিলের কাগজ। তিন মাসের সব বিল যোগ করে একত্রে পরিশোধ করার জন্যও নিদের্শ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে তাদের হাতে নাই কোনো কাজ,রুজি । অন্যদিকে ভয় আছে বিল পরিশোধ না করলে ,কোনোরকম নোটিশ না দিয়ে বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি।
গাড়ি ভাড়া ৬০% বৃদ্ধি করে পরিবহন মালিক সমিতি যেমনটা কথা ছিল যাত্রী কম নিয়ে গাড়ি চলবে তার ১ ভাগও হচ্ছে না। যার দরুন একদিকে যেমন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য দিকে গ্রাম থেকে শহরমুখী হতে বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান ফলাচ্ছে কিন্তু সরকারের নির্ধারিত ধানের দাম পাচ্ছেন না তারা। অপর দিকে চালের দাম উর্ধ্বমূখী। সঠিক দাম না পাওয়ায় অনেকে ধান বিক্রি করতে পারছে না আবার অল্প দামে বিক্রি করেও তাদের পুজিঁ উঠাতে পারছে না। এমতাবস্থায় কৃষকের সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।
একদিকে এনজিওর কিস্তির চাপ অন্য দিকে শস্যের সঠিক দাম না পেয়ে দিশেহারা কৃষক। তাদের কাছে এখন করোনার চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম কিস্তি পরিশোধ করা। হুমকি তো আছেই। কারন এই এনজিওর টাকার ওপর নির্ভর করে অনেক মানুষ তার মেয়েকে বিয়ে দেয়,অনেকে আবার ছোট-খাটো ব্যবসা চালায়,অনেকে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচও চালায়।
এমনটা চলতে থাকলে,এই সকল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো পারিবারিক চাহিদা পূরণ করতে না পারার অপবাদকে সামলাতে না পেরে জীবন হারানোর কাজে উদ্ধত হবে।
– কামাল হোসেনশিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া। শিক্ষাবর্ষ:২০১৮-১৯ইমেইলঃ hossenk919@gmail.com