গত বছরের অক্টোবর মাসে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারা হয় বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। ঐ হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ছাত্রলীগের ২৫ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে আদালতে দেওয়া হয় চার্জশিট। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত করে পাঠানো ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। গত এপ্রিল মাসে মামলার বিচার শুরু হওয়ার জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে আলোচিত এই মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ আছে। শুধু আবরার হত্যাই নয়, ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বিচারও থেমে আছে।
করোনা ভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হত্যা, অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ এ ধরনের চাঞ্চল্যকর শতশত মামলার বিচার কবে শুরু ও শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
এদিকে বিচারের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে যুগোপযোগী করা হচ্ছে দেড়শ বছরের পুরোনো সাক্ষ্য আইন। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আইনটি যুগোপযোগী হলে আসামি ও সাক্ষীকে আদালতে হাজির না করেই ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মামলার ট্রায়াল পরিচালনা সম্ভব হবে। এমনকি ইলেকট্রনিক এভিডেন্সও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে বিচারকদের আর আইনগত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলে ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) ও সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী। এসব আইনে উল্লেখ আছে কীভাবে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা, যুক্তিতর্ক ও রায় প্রদান করা হবে। আইনের ঐ বিধানগুলো পালন না করা পর্যন্ত মামলার ট্রায়াল পরিচালনা করা যায় না। এ কারণে করোনাকালে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণকে সুরক্ষা দিতে মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে ভার্চুয়াল কোর্টে শুধু আসামির জামিন ও রিমান্ড শুনানি চলছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা আইন একটি যুগান্তকারী আইন। সাক্ষ্য আইন সংশোধন হওয়ার পর এই অধ্যাদেশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বিচারিক কাজগুলো শুরু করা যাবে। তখন আমাদের নিম্ন আদালত এবং বিচারিক আদালত তথ্যপ্রযুক্তি মাধ্যম ব্যবহার করে ট্রায়াল, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং যুক্তিতর্ক শুনতে পারবে এবং রায় প্রদান করতে পারবে।
করোনা ভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারাগারে থাকা বন্দিদের বিভিন্ন মামলায় হাজির না করতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়। কারাগারে থাকা বন্দিদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতেই ঐ নির্দেশনা জারি হয়। এই নির্দেশনার পর আসামি কারাগার থেকে হাজির না করায় মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ রাখেন বিচারকরা। কারণ সিআরপিসি ও সাক্ষ্য আইনে উল্লেখ রয়েছে, আসামির উপস্থিতিতে মামলার ট্রায়াল চালাতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় দুই মাস বন্ধ ছিল জামিনসহ আদালতের সব বিচার কার্যক্রম।
পরবর্তীকালে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে গত ১১ মে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হাইকোর্টের প্রণীত প্র্যাকটিস ডাইরেকশন অনুসারে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করা হয়। যেখানে শুধু জামিন শুনানির জন্য বিচারকদের নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। কিন্তু সাক্ষ্য আইন সংশোধন না হওয়ায় মামলার ট্রায়াল এখনো বন্ধ রয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সাক্ষ্য আইন সংশোধন করলেই হবে না, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মামলার ট্রায়াল পরিচালনার জন্য অবকাঠামোগত সব সমস্যাও দূর করতে হবে।
প্রসঙ্গত গত বছরের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। ঐ বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ডিবি পুলিশ। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠানো হয়। গত ৬ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হওয়ার জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু প্রায় তিন মাস ধরে বিচার বন্ধ রয়েছে। মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, বিচার বন্ধ না থাকলে এতদিনে মামলার অনেকগুলো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হতো।
এদিকে আলোচিত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ধৃত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিচারও বন্ধ রয়েছে। ঐ অভিযানে গ্রেফতার প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে সরকারের সংস্থাগুলো। এর মধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলায় ঠিকাদার জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষী, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু আদালতে স্বাভাবিক বিচারব্যবস্থা না ফেরায় বন্ধ রয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ।
এছাড়া বগুড়ায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ ও তার মাকে মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় করা মামলার বিচার বন্ধ। শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারসহ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলেও শেষ হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ। এ সুযোগে আসামি তুফান হাইকোর্টে জামিন চেয়েছেন। আদালত তার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা জানান, বিচার বন্ধের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার সাক্ষ্য আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত