বাবা মানে কারোর নিকট চরম অভিমান, ভালোবাসা, আবেগ খুনসুটির নাম, আবার বাবা মানে কারোর নিকট ভয়, রাগ কিংবা মনোমালিন্যের ব্যাপার । তবে বাবা মানে যেটাই হোক না কেন তার অন্তরে যেন সন্তানদের জন্যে স্নেহ , ভালোবাসায় সবসময় সিক্ত হয়ে থাকে । তদাপুরি ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে । এক্ষেত্রে যেন উক্তিটি একদমই ভুল নয় ।
তবে বাবারা সন্তানদের ভালবাসলেও অনেক সময় ভালোবাসা প্রকাশ না করার কারণে বা দামি আবদার না পূরণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা বা বন্ডিংটা অনেক সময় ঠিকঠাক গড়ে উঠতে পারে না । বাঙালি পরিবারে এই জিনিসটা যেন আরোও বেশি হয়, বাবাকে অনেকে দূর ও ভেবে থাকেন ।
তবে এই দূর হওয়াটা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে , যেমন : সন্তানের আবদার পূরণে ব্যর্থ, তার এক্সটা কেয়ারিং নেওয়া বা লেট নাইট বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়া থেকে বারণ করা, পকেটমানি কম-বেশি দেওয়া এসকল বিষয় গুলো যেন বাবাকে সন্তানদের দিক থেকে দূরে ঠেলে দেয় ।
কেননা একটা বয়সের পর সন্তানেরা সর্বক্ষণই চায় স্বাধীন থাকতে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, দামি মোটরসাইকেল বা ফোনের মতো আবদার ইত্যাদি । যখনই সন্তানেরা এগুলো বাবার কাছে পেতে ব্যর্থ হয় , তখনই যেন তারা ডিপ্রেসনে বা বাবা থেকে দূর দূর হয়ে যায় ।
উচ্চবিত্ত, মধ্যেবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাবাদের মধ্যে সন্তানের জন্যে ভালবাসা ঠিক থাকলেও এই আবদার বা এই দূরের বিষয় গুলো যেন সামান্য ভিন্ন হয়ে থাকে । উচ্চবিত্ত বাবাদের অধিকাংশই সন্তান স্বাধীনতা , অতিরিক্ত পকেটমানি, দামি আবদার এগুলোর পূর্ণতা পায় বলে তাদের সঙ্গে বাবাদের দূর টাও একটু কম কম থাকে বলা যায় ।
নিম্নবিত্ত বাবা বা সন্তানের মধ্যেকার পরিস্থিতি বা দূরটাও যেন একটু স্বাভাবিকই থাকে । এর কারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা সবসময়ই কম পেয়ে, কম দেখেই বড়ো হয় । যার ফলে এদের থাকে না বাবার কাছে কোনো আবদার থাকে না কোনো অপরিপূর্ণতার মতো বড়ো অভিলাষ আশা বা ইচ্ছে । থাকলেও তা অনেকাংশেই কম । যার ফলে তাদের মধ্যোকার বন্ডিংটাও অনেকাংশে ঠিকঠাক থাকে ।
সত্যি বলতে, বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবাদের সঙ্গে সন্তানের মিল বন্ধন অনেকাংশেই বেশি তদাপুরি মধ্যেবিত্তের চেয়ে । তবে অনেকাংশে তার বিকল্প কিছু থাকতে পারে ।
তন্মধ্যে মধ্যেবিত্ত পরিবারের বাবারা যেন একটু ভিন্নই । বলা যেতে পারে মধ্যবিত্ত পরিবারের সুপার হিরো বাবা । কেননা তাদের সেই আধছেড়া বাটা জুতা, ময়লা টি-শার্ট, পুরনো সেই খাকি প্যান্ট একই থাকলেও সন্তানদের ইচ্ছা বা আবদার পূরণে যেন একরাশ ক্লান্তি নেই, নেই কোনো অবসাদ । মধ্যেবিত্ত পরিবারের বাবা , সন্তানদের বা পরিবারের ভরণপোষনের জন্যে সেই এক পোশাক, এক ছাতি, পায়ে হেঁটে অফিস যাওয়া এসবগুলো যেন সুপার হিরোর মতো নিঃস্বার্থে তাদের ভালোবেসে করে যায় বছরের পর বছর ।
পাশাপাশি কিস্তির ঋণ যেন সর্বদা লেগেই থাকে মধ্যেবিত্তের পরিবারের বাবার । ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সন্তানের মোটরসাইকেল বা দামি ফোন কেনা, ঈদের জন্য সন্তানদের নতুন পোশাক কেনা, এডমিশন ফি কিংবা চিকিৎসার জন্য একটুও যেন বাবা পিছুপা হয় না । এই বাবার উদাহরণ টেনেই হয়তো বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘ পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই ‘ ।
সত্যিই হয়তো ঠিকই বলেছিলেন উনি, নাহলে যে বাবা সব সময় সন্তানদের বকাবকি করে কিংবা কড়া শাসনে রাখে, সে বাবাই সন্তানদের জন্য বাজার থেকে বড়ো মাছটা কিংবা এক ডজন ডিম কিনে আনে । জানে যে , শাকসবজি আমার ছেলে বা মেয়ে বেশি একটা খেতে পছন্দ করে না খেতে । আবার সেই বাবাই সন্তানের মোটরসাইকেলের দূর্ঘটনা শুনে হাসপাতালে দৌড়াতে দৌড়াতে যায়ে অস্থির হয়ে পড়ে । কেননা পৃথিবীতে সন্তানদের লাশ বাবার কাঁধে নেওয়ার মতো কঠিন কাজ আর হয়তো নেই ।
তবে বাবা নিম্নবিত্ত, মধ্যেবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত যে পরিবারেই হোক না কেন , সন্তানদের জন্যে বাবার যে ভালোবাসা তা যেন চির মলিন । এই ভালোবাসায় নেই কোনো খাদ্ । বাবা যে সন্তানদের মাথার তাজ বা মুকুট তবে বাবার ক্ষেত্রে তা যেন সম্পূনই ভিন্ন । বরং বাবার নিকট সন্তানই তার মাথার তাজ মনে করে থাকেন ।
বাবা হলো সন্তানদের মাথার ছাদ স্বরুপ । ছাদ যেমনিভাবে আগলে রাখে ঝড়, বৃষ্টি , ধূলাবালি থেকে তেমনি বাবাও তাদের সন্তানদের আগলে রাখে বাইরের সমাজের মানুষের ঝড় থেকে, রক্ষা করে রেসকিউ টিমের মতো । ইমারজেন্সি কোনো বিপদে পড়লে সন্তানরা, বাবাই যেন ইন্সটান্ট এসে রক্ষা করে ।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, বাবা আমাদের পরিবারের সুপার হিরো । যে হিরো নিঃস্বার্থে দিন রাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য । তারা নিজেরা অতিরিক্ত খরচ না করে সন্তানদের জন্য সঞ্চয় করে রাখছেন ।
বাবার নেই কোনো দাবি, নেই কোনো বড়ো আবদার , নেই সন্তানদের কাছে বড়ো চাওয়া পাওয়া । প্রত্যোক বাবার যেন একটাই ইচ্ছে তাদের সন্তান যেন সাফল্যের সবোর্চ্চ সিঁড়ি পাড়ি দিক ।
এই নিঃস্বার্থ , আত্মত্যাগী বাবার জন্যে জানাই লাল সালাম । এই নিঃস্বার্থ, আত্নত্যাগী পরিবারের সুপার হিরো বাবা ছাড়া যেনো অন্য কেউ হয়তো আর হতে পারবে না । তবে বাবা-সন্তানদের মধ্যেকার ভালোবাসা হলো অপ্রকাশ্যের ভালোবাসা । কেউ কাউকে বলতে না পারা ভালোবাসা । সহস্র মানুষের মধ্যে যারা যারা একথাটা তাদের বাবাকে বলতে পারেন , তাদের মতো সৌভাগ্যের অধিকারী হয়তো আর কেউ নেই ।
আজ বিশ্ব বাবা দিবসে আসুন সেই সুপার হিরো বাবার জন্যে পারলে কিছু উপহার দিই । অথবা একবার অন্তত কোলাকুলি করে বলি , বাবা ভালোবাসি তোমায় খুব । আর তাও যদি না পারি তবে বাবার কাজে সহায়তা করি একটু । আর যাদের বাবা নেই, তারা এই দিনে মহান আল্লাহর তায়ালার নিকট বাবার জন্যে দোয়া করি ।
পরিশেষে এই বাবা দিবসে সকল বাবাদের জানাই শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা । ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি সকল বাবা নামক পরিবারের সুপার হিরোদের । আমার বাবা, আমার সুপার হিরো । প্রতিটি দিন হোক, বাবা-সন্তানদের আনন্দের, ভালোবাসার ।
আল আমিন ইসলাম নাসিম
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ।
ইমেইল : alaminislamnasim@gmail.com