শারমিন নাহার তনু
স্কুল মাঠের পাশে বটগাছটি আজও দাঁড়িয়ে আছে। ডালপালা মেলে হয়েছে দিগন্ত প্রসারিত। কত সুখ ও দুঃখ বিজড়িত স্মৃতি গেঁথে আছে গাছটির সাথে। সবাই তাকে ছেড়ে গেলেও সে জানিয়ে যাচ্ছে তার ইতিহাস। আজ প্রায় চার যুগ হতে চললো।
শিহাব ও ফাহিমা তাদের প্রেমের সাক্ষী হিসেবে গাছটি লাগিয়েছিল। সকালে দাঁত মাজার ছল করে গাছে পানি দেওয়ার নামে রোজই ওখানে তারা দেখা করতো। স্কুল মাঠের পূর্ব দিকে ছিল শিহাবের বাড়ি আর পশ্চিম দিকে ছিল ফাহিমার বাড়ি। শিহাবের চেয়ে ফাহিমা বছর দুয়েকের ছোট ছিল। ফাহিমার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা আর শিহাব ছিলো ধবধবে সাদা। রোদে গেলে যেন গোলাপী আভা বের হতো। তাদের প্রেমের বিষয়টি বেশিদিন গোপন রইলো না। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে তাদের প্রেম কাহিনি রটে গেল।
সামাজিকভাবে বেশ নাকানি-চুবানি খেতে হলো। তবুও তাদের একে অপরকে চিঠি দেওয়া, দেখা করা ও গোপনে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা ঠিকই চলছিল। এসব কিছুতে প্রবল বাধা হয়ে ওঠলো ফাহিমার বাবা। তিনি বলেই বসলেন,
‘‘কাঠমিস্ত্রির ছেলে, যাদের ঘর দোর কিছুই নেই, ভাঙা পাটখড়ি ও খেঁজুরের পাতা দিয়ে তৈরি ঘরে থাকে, সেখানে তুই সম্পর্ক পেতেছিস? বজ্জাত-নচ্ছার মেয়ে।’’
একথা কাঠমিস্ত্রির কানে যাওয়ার পরে তিনি ক্ষোভে-জিদে ছেলেকে বললেন,
‘‘ভাঙ্গা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের মাইয়ার লগে তুই প্রেম করিস? এত বড় সাহস!’’
দোষ গিয়ে পড়লো ভাঙ্গা ঘর ও স্কুলের ওপর। সামাজিকভাবে এমন বাজে একটা অবস্থার সৃষ্টি হলো, ফাহিমাকে সপরিবারে ময়মনসিংহের ফুলপুরে পাঠিয়ে দিল তার বাবা। নিজে কিছুদিন অপমানিত হয়ে রাতের আঁধারে এলাকা ছাড়লো।
ফাহিমা ও শিহাব দুপ্রান্তে ছিটকে পড়ে গেল। আর তাদের দেখা সাক্ষাৎ এমনকি চিঠির আদান-প্রদানও রইলো না। কিন্তু শিহাবের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠিগুলো ফাহিমা খুব সযত্নে রেখে দিল এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জীবন পার করতে লাগলো। এদিকে শিহাব বি. এস. সি ইন্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতে হঠাৎ এক স্বপ্ন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। সেই স্বপ্ন যা তার বুকের অনেকটা জুড়ে বাস করছিল। সে আর কিছুই নয়, সে ১৯৯০ সালে ডি ভি লটারি পেয়ে নিজের ভাগ্য ফেরানোর জন্য আমেরিকা পাড়ি দিলো।
শিক্ষিত তরুণ যুবক আমেরিকায় ভালো চাকরি পেয়ে গেল। কষ্টের দিন কেটে গিয়ে সুখ হাতছানি দিতে লাগলো। অর্থ কষ্টের অভাব রইলো না।
বেশকিছু বছর বাবা-মা, ভাই-বোনদের যথাযথভাবে তদারকি করলো।
অন্যদিকে ফুলপুরে ফাহিমা শিহাবের সাথে শতচেষ্টা করেও এতবছর কোনো যোগাযোগ করতে পারছিল না।
শিহাবও কোনো যোগাযোগ রাখেনি। অথচ তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল শত প্রতিকুলতার মধ্যেও কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। এমনি করে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল। শিহাব বাংলাদেশে আসলো।
এলাকায় বেশ নাম-ডাক পড়ে গেল। আশে-পাশের গ্রাম থেকে তাকে দেখতে মানুষ আসতে লাগলো। তার মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলো। দামি পাত্র বলে তার পিছে পাত্রীর লাইন পড়ে গেল। অবশেষে এক আত্মীয়ের মেয়েকে বিয়ের জন্য পছন্দ করা হলো। আই. এ পড়ুয়া মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তারা উঠে-পড়ে লাগলো।
শিহাব যোগাযোগ না করলেও ফাহিমা এ গ্রামে ফেলে রাখা পরিচিত এক বান্ধবীর সাথে ঠিকই যোগাযোগ রাখতো। শিহাব দেশে এসেছে জানতে পেরে ফাহিমা তার বান্ধবী সন্ধ্যার মাধ্যমে শিহাবকে একটি চিঠি পাঠালো। সন্ধ্যা একদিন শিহাবকে বটগাছটির কাছে ডেকে নিয়ে গেলো এবং চিঠিটি দেখালো। বটগাছ, প্রাক্তন প্রেম ও প্রেমিকার কথা শিহাবকে জানালো। চিঠিটায় লেখা ছিল,
‘‘প্রিয় শিহাব,
আমার এত বছরের সঞ্চিত ভালোবাসার শুভেচ্ছা রইলো। আমি আজ দুই বছর যাবৎ বি. এ পাশ করে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। বাবা উন্মাদ হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাউকে চিনতে পারছে না। মা ও ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে আমি বিপদে আছি। চিঠি পাওয়া মাত্রই যোগাযোগ কর।’’
ইতি তোমার
ফাহিমা।
চিঠিটা পড়ে শিহাব ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘‘ওকে কে অপেক্ষা করতে বলেছে। ওর কথা তো আমার মনেই নেই। ওর সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক হয়নি, যে ওকে বিয়ে না করলে আমার পাপ হবে!’’
এই বলে শিহাব চিঠিটি ছিড়ে ফেললো। যেন ফাহিমার হৃদয়টাকেও সে ছিড়ে ফেললো। সে আদিম যুগের জৈবিক তাড়নার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করলো। ভদ্র ছেলের মতো আত্মীয়ের মেয়েকে মহাধুমধামের সাথে বিয়ে করে নিল। ওদিকে সানাইয়ের করুণ সুর যেন ফাহিমা বিয়োগের সুরই বাজিয়ে যাচ্ছিল। পৃথিবীর বাস্তব এবং মর্মান্তিক পরিবেশে আটলান্টিক মহাসাগরের এপারে ওপারে দুজন ছিটকে পড়ে গেল।
বউটিকে সে আমেরিকা নিয়ে গেল। দু বছরের মাথায় সে একটি পুত্র সন্তানের বাবা হলো। শিহাব এই বউটির জন্য পাগলপ্রায়। মেয়েটি বয়সে অনেক ছোট হলেও মাথা বাত্তি ছিল। ভাই ও বোন যেভাবে তাকে বলতো শিহাবকে দিয়ে সে তাই করিয়ে নিত। তবে তার নিজের বৈষয়িক বুদ্ধি কোনো অংশে কম ছিল না।
দাম্পত্য জীবন তাদের ভালোই কাটছিল। এই জীবনের এক ফাঁকে বউটি শিহাবকে বললো,
‘‘আমাকে ঢাকাতে একটি ফ্ল্যাট কিনে দাও।’’
যথা আজ্ঞা, পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিয়ে সে সময় ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বিশাল ফ্ল্যাট কিনে বউকে উপহার দিল। এতে বউ এর খুশি যেন আর ধরে না। দিনকে দিন বউ এর চাওয়ার মাত্রা আরও বেড়ে গেলে। টঙ্গিতে কয়েক কাঠার জমি ও বাড়িও তাকে লিখে দিতে হলো। তরুণী বউ বলে কথা! ফেলতে পারছেনা।
দেশে তার শিক্ষিত বেকার ভাইকে রড সিমেন্টের বিশাল ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিল। এমনকি তার বাবা মাকেও আমেরিকা নিয়ে দিল।
মেয়েটির আবদার সামলাতে গিয়ে শিহাব নিজের বাবা-মার কথা ভুলেই গেল। যখন শিহাবের বাবা প্রচুর অসুস্থ হয়ে মারা গেল, তখন তার একটু হুঁশ হলো। সে এটা কী করছে! গ্রামের মানুষ বলতে লাগলো,
‘‘ভাই-বোনকে না হয় না-ই দেখলি নিজের বাবা-মাকে তো দেখতে পারিস।’’
এই অবস্থায় অসুস্থ মাকে বিদেশ নিয়ে ডাক্তার দেখানোর চিন্তা করলো। কিন্তু বউটি পরিষ্কার জানিয়ে দিল,
‘‘আমি তোমার মাকে একটুও দেখতে পারবো না। তুমি কেন একা তাদের পিছনে টাকা খরচ করবে। সব ভাই-বোন মিলে ভাগা-ভাগি করে করবে।’’
শিহাব এ কথা শুনে ভাবলো,
‘‘এই মাথা পাকনা মেয়েটাকে হয় তার ভাই-বোন বুদ্ধি দিয়েছে, না হয় সার্টিফিকেটে কমপক্ষে পাঁচ বছর লুকানো আছে। আমি যা পয়সা রুজি করি অন্যেরা তো তা করে না।’’
আস্তে আস্তে শিহাব তার পিতৃতব্য পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেল।
বউটি একদিন শিহাবের কাছে আবদার করে বসলো সোনার নূপুর বানাবে। সে সেটাও গড়িয়ে নিল। মানুষ বললো,
‘‘মাথার সোনা পায়ে নামালি?’’
সোনার নূপুর পায়ে দিয়ে সে নেচে নেচে বেড়াতে লাগলো। বাংলাদেশে ঘন ঘন আসতে শুরু করলো। প্রজাপতির রঙিন পাখায় ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে, রঙিন স্বপ্নে বিভোর। স্বপ্ন যে তার সত্যি হতে চলেছে। কী আনন্দ!
ব্যস্ততার কারণে শিহাব বউ এর ঠিকমতো খোঁজ রাখতে পারছিল না। বউ এর খবর নিতে গিয়ে দেখলো, সে তার কলেজ পড়ুয়া বন্ধুটির সাথে নতুন সংসার পেতেছে।
শিহাব বুঝতে পারলো, এতবছর মেয়েটি শুধু তার সাথে অভিনয় করেই গিয়েছে। আজ তার যবনিকাপাট ঘটলো।
মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড শুরু থেকে এই সোনার হরিণটির পেছনে লেগে ছিল। বয়ফ্রেন্ডটি ভেবেছিল,
‘‘দেশে চাকরি করে ৬০-৬৫ বছরে হয়তো লাখ লাখ বা কোটি কোটি টাকা পেতে পারি। আর যদি এই সোনার হরিণটিকে ফাঁদে ফেলতে পারি, তাহলে ২৫-৩০ বছরেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাব।’’
এবং সে তা-ই করলো। দুনিয়াতে কত রকমের ধান্দাবাজ আছে তা আশে পাশে তাকালেই অনুভব করা যায়।
শিহাব এত বছরের জীবনে যা গড়েছিল, এই বউটির আবদার রাখতে গিয়ে সব খুইয়েছে। দেশ-বিদেশের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সও খালি। এমনকি নিজের পুত্রটিকে ধরে রাখতে পারে নি। দাম্পত্য জীবনের এমন পরিস্থিতি তাকে যে এতটা নাজেহাল করবে তা সে ভাবতেও পারে নি। তবুও এই বাস্তব ও কঠোর জীবন তাকে মনে না নিলেও মেনে নিতে হলো।
গ্রামের মানুষ বলতে লাগলো,
‘‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ফাহিমার অভিশাপ এবং দীর্ঘশ্বাস তোর জীবনটাকে নরকে পরিণত করে দিল।’’
অনেক বছর পর শিহাব তার ভাই-বোনদের দিকে ফিরে তাকালো। সবাইকে সাহায্য সহযোগিতা করতে লাগলো, সবার কথামতো দ্বিতীয় বিয়ে করলো। এবারের বউটি আর অল্পবয়সী তরুণী নয় বিপত্নীক এক মহিলা।
এইসব ঘটনা বটগাছটি নীরবে দেখলো অার মুখ লুকিয়ে গোপনে হাসলো।
লেখকঃ শারমিন নাহার তনু, শিক্ষিকা ও সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।