শাম্মী আক্তার তন্নী (বেলা)
আমার নাম তনু। ডা: উষ্ণতা আক্তার তনু। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। বাবা-মা, আমি মিলে আমাদের একটি সুখী পরিবার। আমি ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় খুব ভালো ছিলাম। ইন্টার পাশ করার পর মেডিকেলে এডমিশন দেয়,ভাগ্যক্রমে আমি মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায়। আমি বাবা মায়ের একটা মাত্র মেয়ে হওয়ায় অনেক আদরের। জন্মের পর থেকে কখনো বাবা-মাকে ছাড়া কোথাও থাকি নি। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর জীবনে এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে অনেক দূরে আছি। যখন পরিবারকে ছেড়ে এই অচেনা শহরে প্রথম আসি তখন নিজেকে খুব একা লাগত। আস্তে আস্তে সবকিছুর সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম।নতুন বন্ধু-বান্ধব পরিবেশ একদম নতুন ছিল। একদিন মেডিকেলে ক্লাসে ঢোকার সময় হিমেল নামের এক ছেলের সাথে আমার ধাক্কা লাগে।ডা:শাদুল্লাহ হিমেল।সে ছিল আমার ব্যাচেরই একজন মেডিকেল ষ্টুডেন্ট। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় তার সাথে বন্ধুত্ব।
সে খুব কেয়ারিং ছিল আমার উপর। আমার জীবনে সব মূহুর্তে পাশে থাকতো,খারাপ মূহুর্তে আমাকে সাহস জোগাত।আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।আমরা দুজন-দুজনাকে খুব পছন্দ করতাম কিন্তুু আজ প্রর্যন্ত কেউ কাউকে বলা হয়ে ওঠেনি।তারপর শেষ হলো আমাদের ডাক্তারি পড়া।ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, এখন সেই স্বপ্ন পূরন হয়েছে। আমি বর্তমানে একটা হাসপাতালের ডাক্তার হিসেবে কর্মরত আছি।তারপর থেকে শুরু হল আমার জীবনের ব্যস্ততা। এখন আমার সারা দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে রোগীদের সাথে। পরিবারকে ছাড়া নিজেকে মাঝে মাঝে খুব একা লাগে কিন্তু হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে আমার ব্যস্ত জীবন অতিবাহিত হচ্ছে।রোগীদের সেবা করার মাধ্যমে আমি আমার জীবনের আনন্দ ও সার্থকতা খুঁজে পাই। হঠাৎ কয়েকদিন যাবৎ সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। এই মহামারী ভাইরাস আমাদের জীবনকে থমকে দিয়েছে। সেই ভাইরাসটি হলো কোভিড- ১৯। প্রতিদিন অনেক রোগীকেই সেবা দিতে হয়। কেউ আসে শ্বাসকষ্ট নিয়ে, আবার কেউবা আসে সর্দি জ্বর কাশি গলা ব্যথা নিয়ে…..
চোখের সামনে কত মানুষ যায় তার স্বজনদের হারাতে দেখছি! সে কি যে নির্মম দৃশ্য চোখে না দেখলে তো অনুভব করা যায় না,কিন্তু আমি এখনো ক্লান্ত হইনি এখনো ভেঙে যায় নি।নিরলস পরিশ্রম করে মহামারী ভাইরাস কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।আমার এই মনোবল ও অনুপ্রেরণার মূল উৎস হলেন আমার দাদু । আমার দাদু ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে নিরলস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেন। দাদুর কাছে শুনেছি, বাঙ্গালীদের কাছে যুদ্ধের সময় তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না যার কাছে যা কিছু ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।বাঙালিরা কখনোও মনোবল হারায়নি তারা নিরলসভাবে যুদ্ধ করে গেছে দেশের জন্য। দাদু তুমি দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হওনি।
পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে তোমার পা হারিয়েছো,আল্লাহর অশেষ রহমতে তোমার জীবনটা রক্ষা পেয়েছে।তোমার মুখে গল্প শুনে আমি অনুপ্রাণিত। মুক্তিযুদ্ধের মতো কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমার মত হাজারো ডাক্তারদের। আমাদের কাছেও এই অদৃশ্য মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত তেমন কিছু নেই। সীমিত সংখ্যক পিপিই,হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, বিশেষ চশমা, আর কিছু সীমিত ওষুধ। এখন পর্যন্ত আমরা তৈরি করতে পারিনি অদৃশ্য ভাইরাস টাকে ধ্বংস করার ওষুধ। তবুও আজ আমরা থেমে নেই লড়াই করেই যাচ্ছি।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন,অনেক মা ফিরে পাচ্ছেন তার সন্তানদের। আবার অনেকে হারাচ্ছেন তার প্রিয়স্বজনদের। কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনসহ কেউই কাছে যাচ্ছে না তার শেষকার্য/সৎকার সম্পূর্ণ করছে সরকারি সংস্থার কিছু লোকজন। আমার অনেক সহকারি ডাক্তার বন্ধুরাও করোনাই আক্রান্ত হচ্ছেন। গত সপ্তাহে আমার বন্ধু ডা:শাহদুল্লাহ হিমেল তারও করোনা পজেটিভ হয়েছে। হঠাৎ তার করোনা পজিটিভ শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি!আজ ২ দিন যাবত আমি ঘর থেকে বের হই না।কিছুদিন ধরে আমার গলা ব্যথা ও জ্বর অনুভব করছি..
রোগীদের সেবা দিতে যেয়ে নিজের শরীরের যত্ন নিতে পারেনি। আমি করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম এইমাত্র রিপোর্টটা হাতে পেলাম। রিপোর্টটা পাওয়ার পরে আমার গা শিউরে উঠলো, যে পরিস্থিতির জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না…রিপোর্টে দেখলাম আমার করোনা পজিটিভ হয়েছে।কিন্তু তবুও আমি ভেঙে পরিনি কারণ ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল দেশের মানুষদের জন্য কিছু করার। ডাক্তারি পেশায় যোগদানের সময় মনে মনে শপথ করেছিলাম নিজের জীবন উৎসর্গ করে হলেও রোগীদের সেবা দিয়ে যাবো।আমি বিশ্বাস করি আমি সুস্থ হবো ইনিশআল্লাহ।আমি করনা বিজয়ী হয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে যাবো।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের মানুষের সেবায় ব্রতী হতে চাই।এখন এটাই মূলত আমার জীবনের একমাত্র ইচ্ছা……….