করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ভারতে একদিনে সর্ব্বোচ্চ ৬ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এই করোনায়। ভারতের ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, যশোর সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গায় সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। যদিও মৃত্যুহার ভারতের তুলনায় এখনও কম।
তবে সংক্রমণের হার বাড়লে মৃত্যুহার ও বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক বলে বলছেন স্বাস্থ্য বিভাগ হতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো প্রথমধাপে করোনা শুরু হলে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেছিল জনগণ ঠিক তেমনটি এখন দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে মানুষের মাঝে সচেতনতা বা সামাজিক দূরত্ব মানা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং হাতধোয়া এই বিষয়গুলোতে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে সংক্রমণের হার বেড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে যে আইন বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে তা যথেষ্ট। জনগণ সচেতন হলে এবং সরকারি উদ্যোগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন প্রয়োগে কঠোর হলে করোনার বিস্তার রোধ করা সম্ভব।
এটা আমাদের দুর্ভাগ্যই যে, আমরা এই প্রজন্মের যারা, তাদের কোভিড-১৯ নামের নিষ্ঠুর অদৃশ্য দানব করোনাভাইরাস ফেস করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যে তাণ্ডব এই ভাইরাস চালাচ্ছে, তাতে প্রতিটি মুহূর্ত আনাগত মৃত্যুর আতঙ্কে কাটছে। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন, স্বাস্থ্যসচেতন ও সামাজিক দূরত্বসহ কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিপালনে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে তথা পরিবার ও সমাজের সবাইকে নিরাপদ রাখা সম্ভব।
করোনা ঠেকাতে ১২ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত বিধিনিষেধ চলমান রয়েছে। আংশিক লকডাউন জেলাভিত্তিকও চলছে। ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে বাংলাদেশে গত ৩০ মে থেকে সীমিত আকারে গণপরিবহন, দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে আশঙ্কার ব্যাপার হলো এই সময় করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সরকার বলছে করোনার সাথেই যেহেতু চলতে হবে, সেখানে এটাকে মেনে নিয়ে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে করোনা মোকাবেলা করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রামক প্রতিরোধ (নির্মূল, নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৮ এর বিধানমতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। যেমন, মাস্ক না পরলে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো, এই স্বাস্থ্যবিধি বা আইন কি জনগণ আদৌ মানছে? বা আইন মানাতে সরকার যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী কী ব্যবস্থা নিয়েছে? বা আইন প্রতিপালনে অধিক জনসংখ্যার দেশে বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সক্ষমতা কতটুকু ইত্যাদি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সারা বিশ্বে বাই-রোটেশন লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে ছুটি বা লকডাউন তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকা সচল করতে এই সিদ্ধান্ত ঠিকই। তবে সরকারের উচিত হবে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মাস্ক পরাতে ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জনগণকে বাধ্য করা। বাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু জনগণ বা বাস মালিকরা কি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করছে? তা দেখভালের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কঠোর হতে হবে। নাহলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগবে না।
গতকাল ১০ জুন পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১২ হাজার ৫০০ পরীক্ষা করে ২ হাজার ৯১১ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩৭ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু প্রায় ১৩ হাজার। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু। এসব কিসের লক্ষণ! না জানি আমরা সবাই আবার করোনা পজিটিভ হয়ে যাই। তবে আশার বাণী হলো, যদি আমরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এগিয়ে আসি বা নিজেরা স্বাস্থ্যসচেতন হই তাহলে এটা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
করোনা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যপালনীয় কিছু নিয়ম জেনে রাখতে হবে। জন হপকিন্স সেন্টারের দেওয়া কিছু তথ্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
১। বদ্ধ পরিবেশে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। চেষ্টা করুন দরজা-জানালা খোলা রেখে ঘরে আলো-বাতাসের চলাচল বৃদ্ধি করতে। নিজে কিছুক্ষণ পরপর চেয়ার ছেড়ে বাইরে গিয়ে আলো-বাতাস নিন।
২। সবার মুখে মাস্ক পরিধান। প্রতি পনের মিনিট অন্তর স্থান পরিবর্তন, কোনো ধরনের বস্তুতে হাতের স্পর্শ না লাগানো, কিংবা নিজের মুখে হাত লাগানো থেকে বিরত থাকলে করোনা আক্রান্ত হওয়ার হার অনেকাংশে কমে যায়। অর্থাৎ বাইরে গেলে এসব বিষয়ে সব সময় সচেতন থাকুন।
৩। গণজমায়েত থেকে নিজেকে সব সময় দূরে রাখুন। যেকোনো ব্যক্তি থেকে কমপক্ষে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করুন সব সময়। পারতপক্ষে ড্রাইভার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করুন। তবে তার বেতন দিন। নিজেকে সর্বোচ্চভাবে অন্যের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
৪। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলুন। সব সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। সাবানপানির ব্যবহার করার সুযোগ থাকলে আরও ভালো। বাসায় ফেরার পরপরই হাত-মুখ ধুয়ে নিন। ব্যবহৃত কাপড়গুলো ধুয়ে ফেলুন।
৫। রেসপিরেটরি হাইজিন অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবশ্যই মেনে চলবেন। সর্দি, কাশি, হাঁচি দেবার সময় সতর্ক থাকুন। অন্যদের এসব করতে দেখলে দ্রুত সেখান থেকে সরে যান।
৬। যেসব জিনিস অন্যের সাথে ব্যবহার করতে হয়, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। যেমন পার্কের বেঞ্চ, বাস বা ট্রেনের সিট, রিকশা, অফিসের দরজা, লিফটের বোতাম, হোটেল বা রেস্তোরাঁর প্লেট গ্লাস কাপ ইত্যাদি। অফিসে নিজের বাসার খাবার গ্রহণ করুন। সম্ভব না হলে শুকনো খাবার খান।
৭। ঘরের বাইরে যত কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। এ জন্য একটি বিশ্বস্ত বন্ধুগ্রুপ তৈরি করুন যারা একই ধরণের হাইজিন প্র্যাকটিস করেন। একাকিত্ব আপনার ইমিউনিটি কমিয়ে দেয়। তাই সুস্থ মানসিক পরিবেশ তৈরি করুন।
৮। সকালে কিংবা রাতে অর্থাৎ যখন মানুষের সমাগম কম হয়, সেসময়ে হাটার অভ্যাস চালু রাখুন। এই ভাইরাস দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের মাঝে বেশি পরিমাণে ছড়ায়।
৯। পর্যাপ্ত পরিমাণে লেবুর শরবত, আদা-লেবু চা, গ্রিন টি, গরম দুধ কিংবা টক দই খাওয়ার অভ্যাস করুন। মাঝে মাঝে গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করতে থাকুন। প্রচুর ফলমূল শাক-সবজি অর্থাৎ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। ভিটামিন সি ডি এবং জিংক সমৃদ্ধ খাবার বেশি গ্রহণ করুন। ভিটামিন ডি-এর উৎস যেমন দুগ্ধজাত পণ্য, বাদাম, সামুদ্রিক মাছ, ছোট মাছ খান। এগুলো আপনার ইমিউনিটিকে বুস্ট আপ করবে।
১০। যারা অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা কিংবা অন্যান্য ক্রনিক রোগে আক্রান্ত বা বয়স্ক ব্যক্তি, তারা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন। পারতপক্ষে বাসার বাইরে না যাওয়াই ভালো।
উপরের বিষয়গুলো সবাইকে অত্যন্ত সচেতনভাবে মেনে চলতে হবে। তবে আমাদের দেশের মানুষের সমস্যা হলো স্বেচ্ছায় আইন মানতে চায় না। তাই সরকারকে জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে দেশে যে উপযুক্ত আইন রয়েছে তা প্রতিপালনে জনগণ ও স্টেকহোল্ডারদের বাধ্য করা। সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ যেন নিজে বাঁচার পাশাপাশি অন্যকে সংক্রমিত না করতে পারে সে লক্ষ্যে আইনটি করা হয়। এই আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধানও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সমস্যা হলো আইনটি সম্পর্কে জানে না অনেকেই। অধিকাংশ মানুষই এই আইন সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল না হওয়ায় মানার বিষয়েও তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এই আইনের ওপর সচেতনতা থাকলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই জন্য মানুষ যেন আইনটি সম্পর্কে জানতে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি বলেই তাদের অভিমত।
‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ নামে বাংলাদেশে দারুণ কার্যকরী আইন আছে। জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এ আইন লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন নিতে হবে। সরকার দেশের সকল জণগণকে টিকা দিতে প্রস্তুত রয়েছে এবং সমন্বিত উদ্যাগের মাধ্যমে দেশের ১৮ বছরের উপরে সবাইকে টিকাদান নিশ্চিত করতে পারলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব।
বিদ্যমান আইনে সংক্রামক রোগের সিডিউলে COVID-19 এর নাম নেই, তবে সরকার ইতোমধ্যে গেজেট করে করোনাভাইারাস বা কোভিড-১৯ রোগকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই এই আইনটি প্রয়োগে এখন আর আইনগত কোনো প্রতিবন্ধকতা নাই। বিধায় এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে মানুষকে মাস্ক পরতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। যদিও আপন সচেতনতার বিকল্প নেই।
লেখক: আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট