মোঃ নূরুল হক
প্রবাদ বাক্য আছে “অসির চেয়ে মসি বড়”- Pen is mighter than the sword. এখানে ‘অসি’ মানে ‘তলোয়ার’ এবং ‘মসি’ মানে ‘কলম’। আর ‘কলম’ শব্দের সাধারণ অর্থ হল ‘লেখনী’। ‘কলম’ এর ইংরেজি ‘Pen’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Penna’ হতে যার অর্থ ‘পাখির পালক’। এক সময় লেখনী হিসেবে পাখির পালক ব্যবহৃত হত বলে এরূপ নামকরণ। লেখার উপকরণ হিসেবে কলমের ব্যবহার স্মরণাতীত কাল হতে সুবিদিত। যদিও কলমের ধরন ও শ্রেণি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। মানব সভ্যতার প্রাচীণ পর্যায়ে গুহার মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের আঁকিবুঁকি হত বলে জানা যায়। তা-ই মূলত মানব সমাজে লেখনীর সূচনা পর্যায়। ধীরে ধীরে তা উন্নত হতে থাকে। তবে কলম বা তার অনুরূপ বস্তুর বিস্তর ব্যবহার ছিল সব যুগেই। এবার আসা যাক, কলমের পার্থিব ইতিহাসেরও আদি কথায়।
মহান আল্লাহপাক সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে কলম সৃষ্টি করেন। তাফসিরকারকদের মতে, আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে মহান আল্লাহপাক এই কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকদির লিপিবদ্ধকরণের ব্যবস্থা করেন। যেমন মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ “সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা কলম সৃষ্টি করেন এবং ওকে বলেনঃ “লিখো”। কলম বলে “কি লিখবো?” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তকদীর লিখে নাও।” (আংশিক) ( ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)। সুতরাং ঐ দিন থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবার আছে সবগুলোই কলম লিখে ফেলে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম কলম ও মাছ সৃষ্টি করেন। কলম জিজ্ঞেস করেঃ “কি লিখবো?” উত্তরে বলা হয়ঃ “কিয়ামত পর্যন্ত যতকিছু হবে সবই লিখে নাও।” (আংশিক) (ইমাম তিবরানী (রঃ) হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)। তাছাড়া হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন। তারপর নূন অর্থাৎ দোয়াত সৃষ্টি করেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা কলমকে বলেনঃ “লিখো”। কলম বলেঃ “কি লিখবো?” উত্তরে আল্লাহ বলেনঃ “যা কিছু হচ্ছে এবং যা কিছু হবে যেমন আমল, রিযিক, বয়স, মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছুই লিখে নাও। তখন কলম ওগুলো লিখে নেয়।” (ইবনে আসাকির (রঃ) হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)। অতঃপর কলমের উপর মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত ওটা আর চলবে না। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের দু’টি জায়গায় ( আমার জানা মতে) কলম বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এক. সূরা আলাকের ৪নং আয়াতে যেমনঃ সূরা আল-আলাক, আয়াত ৪
الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ
অাল্লাযী ‘আল্লামা বিলকালাম।
অর্থঃ যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।
দুই. “আল ক্বলম” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাই নাযিল হয়েছে, যার প্রথম আয়াতেই কলম বিষয়ে বলা হয়েছে, যেমনঃ সূরা আল-ক্বলম, আয়াত ১
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
ن ۚ وَالْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ
নূন ওয়াল কালামি ওয়ামা- ইয়াছতুরূন।
অর্থঃ নুন, শপথ কলমের এবং ওরা যা লিপিবদ্ধ করে তার।
এখানে কলমের নামে শপথ করে মহান আল্লাহ তা’আলা কলমের মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছেন। আর এ কলম হল সেই নুরানি কলম বা কুদরতি কলম যা চালিত হয়েছে এমন সব জিনিসের উপর যেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে। এ বিষয়ে ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বলেনঃ আমাকে খবর দেয়া হয়েছে যে, ওটা এমন একটি নূরানী কলম যার দৈর্ঘ্য একশত বছরের পথ। একথাও বলা হয়েছে যে, “নূন” দ্বারা দোয়াত এবং “ক্বলম” দ্বারা কলমকে বুঝানো হয়েছে। হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদাহ (রঃ)ও একথাই বলেছেন। মহান আল্লাহপাকই মানুষকে লিখন শিক্ষা দিয়েছেন।
( বিস্তারিত তাফসিরে ইবনে কাছির)।
জানা যায় যে, পৃথিবীতে মিসরীয়রাই প্রথম লিখনবিদ্যা আয়ত্ত করেন। যা হোক, দুনিয়ার জীবনে এ কলমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অলিখিত কোন কিছুর চেয়ে লিখিত কিছু গুরুত্ব পায় তা সব সভ্য সমাজে স্বীকৃত। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের কলম দেখা যায়, যেমন- খাগের কলম (নল বা খাগড়া ব্যবহার হত), গাছের কলম, বাঁশের কলম, পালকের কলম, দোয়াত বা কালির কলম, টিপ কলম, ঝরনা কলম, নিবের কলম, বল পয়েন্ট পেন বা বলপেন ইত্যাদি। আধুনিক যুগে প্রথম কলম আবিষ্কার হয় ১৭৮০ সালে ইংল্যান্ডে। আর আধুনিককালের জনপ্রিয় বল পয়েন্ট পেন বা বলপেন আবিষ্কার করেন ১৯৮৮ সালে এক হাঙ্গেরিয়ান। পৃথিবীতে বর্তমানে হাজার রকমের কলম প্রচলিত থাকলেও বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে কলমের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসছে। আর একে আলামত হিসেবে বলা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন এক প্রজন্ম জন্মলাভ করবে যারা সত্যিকার অর্থে হাতে কলমে লিখতে পারবে না, সম্পূর্ণরূপে যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়বে। “কালি কলম মন, লিখে তিনজন” হয়তো এ প্রবাদ বাক্যের সত্যতা ফুরিয়ে আসছে। আর চৌদ্দশত বছর আগে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কী বলেছিলেন জানেন? সত্যিই বর্তমান বাস্তবতাদৃষ্টে তা শতভাগ বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে হয়।
সুনানে নাসায়ী-তে বর্ণিত হাদিস নম্বরঃ ৪৪৬৮ এর একটি হাদিসের শেষাংশ হল -“….. সারা গ্রাম তালাশ করেও লেখতে জানে- এমন কাউকে পাওয়া যাবে না”- যা হযরত আমর বিন তাগলিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, স্বয়ংক্রিয় টাইপিং সিস্টেম প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে অদূর ভবিষ্যতে এমন প্রজন্ম আসবে – যারা হস্তলিপি বুঝবে না বা লেখতে পারবে না- এ হাদিসের মাধ্যমে তা উদ্দেশ্য হতে পারে। সুতরাং, “কলম” মহান আল্লাহপাকেরই সৃষ্টি এবং তা দ্বারা তাবৎ সৃষ্টির রহস্য লিখা হয়েছে। আল্লাহকে জানতে হলে তাঁর সৃষ্টিকেও জানতে হবে। আসুন আমরা আল্লাহর রঙে রঙিন হই।
“বাল্লিগু আন্নি ওয়ালাও আয়াহ”/” আমার নিকট হতে একটা আয়াত হলেও অপরের কাছে পৌঁছে দাও”- বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অমীয় বাণী।
লেখকঃ মোঃ নূরুল হক, সহকারী জজ, গাইবান্দা ।