শিক্ষক নিয়োগে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। বিভাগভেদে প্রভাষক নিয়োগে প্রার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষার ফল সিজিপিএ–৩ দশমিক ২৫ থেকে ৩ দশমিক ৫০ থাকতেই হবে। এই পদে নিয়োগে প্রয়োজনে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে সেখান থেকে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করা যাবে।
বর্তমানে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়।
সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক নিয়োগেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ফলের পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও ন্যূনতম প্রকাশনা কতগুলো থাকতে হবে, তা–ও বলে দেওয়া হয়েছে। “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নয়নের যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের নির্দেশিকায়’ শিক্ষক নিয়োগের জন্য এ রকম বিভিন্ন নিয়মকানুন রয়েছে। এতে শিক্ষকদের পদোন্নয়নের (আপগ্রেডেশন) নিয়মকানুনও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
অভিন্ন নিয়োগ নির্দেশিকা প্রকাশ। প্রভাষক নিয়োগে প্রার্থীকে বিভাগভেদে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষার ফল সিজিপিএ–৩ দশমিক ২৫ থেকে ৩ দশমিক ৫০ থাকতেই হবে।
দেশি-বিদেশি প্রথিতযশা অধ্যাপককে ‘ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর’ পদে চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ।
দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আলোচনা-সমালোচনার পর কয়েক দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটি অনুমোদন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে পাঠিয়েছে। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে আরও বেশি যোগ্যতা নির্ধারণ করতে পারবে, কিন্তু কোনোভাবেই এই নির্দেশিকার চেয়ে কম যোগ্যতার কাউকে নিয়োগ করতে পারবে না।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন নির্দেশিকায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলের কথা কিছুই বলা হয়নি। এ বিষয়ে ইউজিসির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আলোচনার ভিত্তিতেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলের কথা বাদ দিয়েছেন। কারণ, শিক্ষক হওয়ার জন্য মূলত স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলই গুরুত্বপূর্ণ।
লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নির্বাচন।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশি-বিদেশি প্রথিতযশা অধ্যাপককে ‘ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর’ পদে চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে নতুন নির্দেশিকায়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে ইউজিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কারণ, এত দিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করে যোগ্যতা নির্ধারণ করে শিক্ষক নিয়োগ করে আসছে। এতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের সুবিধামতো যোগ্যতা ঠিক করে। এমনকি কোনো কোনো উপাচার্য নিজেদের স্বজনদের নিয়োগ দিতে নিয়োগের যোগ্যতা শিথিল করছেন বলে ইউজিসির তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। এসব কারণে অনেক সময় অযোগ্য প্রার্থীরাও শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে দেশে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। মোট শিক্ষক আছেন ১৫ হাজার ৫২৪ জন।
নিয়োগে যেসব যোগ্যতা লাগবে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও আইন অনুষদের বিভাগগুলোতে প্রভাষক হওয়ার জন্য প্রার্থীকে অবশ্যই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় সিজিপিএ-৪–এর মধ্যে ন্যূনতম ৩ দশমিক ৫০ থাকতেই হবে। আর মানবিক অনুষদের বিভাগগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের যেকোনো একটি ন্যূনতম ৩ দশমিক ৫০ এবং অন্যদিকে ন্যূনতম ৩ দশমিক ২৫ থাকতেই হবে।
এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হলেও এ কারণে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের যোগ্যতা শিথিল হবে না।
বর্তমানে কোনো ক্ষেত্রে চার বছরের স্নাতক ডিগ্রি দিয়েই শিক্ষক হওয়া যায়। নতুন নির্দেশিকায়, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদভুক্ত বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। এর মধ্যে স্নাতকে সিজিপিএ-৪–এর মধ্যে ন্যূনতম ৩ দশমিক ৫০ থাকতেই হবে। স্থাপত্য বিভাগে অবশ্য আরেকটু কম হলেও হবে।
কৃষি ও কৃষিপ্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বা সংশ্লিষ্ট অনুষদ বা বিভাগে পাঁচ বছর মেয়াদি ডিভিএম বা সমমান পরীক্ষায় সিজিপিএ–৩ দশমিক ৫০ থাকতে হবে। তবে স্নাতকে অথবা ডিভিএম বা সমমান পরীক্ষায় মেধাতালিকায় শীর্ষ ১০–এ থাকা ছাত্রছাত্রীরা প্রভাষক পদে আবেদন করার যোগ্য হবেন।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে স্নাতক ডিগ্রিধারীকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয় তারা আগামী দুই বছর পর্যন্ত প্রচলিত নিয়মেই নিয়োগ করতে পারবে। তবে দুই বছরের পর আর এই সুযোগ থাকবে না।
সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রভাষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ন্যূনতম তিন বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
তবে এমফিল ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে প্রভাষক পদে দুই বছর এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে এক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলেই হবে। আর স্বীকৃত জার্নালে (পিয়ার রিভিউ) ন্যূনতম তিনটি প্রকাশনা থাকতে হবে। সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগে সহকারী অধ্যাপক ন্যূনতম সাত বছরসহ ১২ বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা শিথিলযোগ্য হবে। প্রার্থীদের স্বীকৃত জার্নালে ছয়টি প্রকাশনা থাকতে হবে। অধ্যাপক পদে (গ্রেড-৩) নিয়োগে সহযোগী অধ্যাপক পদে ন্যূনতম ১০ বছরসহ ২২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এখানেও এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা ছাড় পাবেন। আর মোট ১২টি প্রকাশনা থাকতে হবে।
নিয়োগের সময় প্রার্থীর সনাতন পদ্ধতির ফল থাকলে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শিথিল করা যাবে।
চুক্তিতে নিয়োগের সুযোগ
ইউজিসির নীতিমালার ভিত্তিতে দেশি-বিদেশি প্রথিতযশা অধ্যাপককে চুক্তি ভিত্তিতে ‘ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর’ পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে। নতুন এবং বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এমনকি কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞ বা গবেষককে ‘ডিস্টিংগুইশ এক্সপার্ট’ হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ করা যাবে। বর্তমানে এই সুযোগ নেই।
নির্দেশিকা প্রণয়নের আলোচনায় যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। নির্দেশিকায় বেশ কিছু ভালো দিক আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে এই নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের উচ্চশিক্ষার পথ অগ্রসর হবে। তবে উচ্চশিক্ষার পথ অগ্রসরের জন্য কেবল এটিই একমাত্র উপায় নয়। শিক্ষকদের গবেষণায় আরও উদ্বুদ্ধ করা ও তাঁদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা এবং একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।