নিশির শিশির
মোঃ আল আমিন প্রধান
প্রতিদিন বাবা বাসায় আসলেই নিশি মামুনিটার নানা বায়না , বড় ভাইয়ার সম্পর্কে মিছে মিছি কৈফত , সবশেষে তার জন্য চকোলেট অথবা মজার কোন খাবার চাই-চাই। মধ্যবিত্ত পরিবার, খাবার, পোশাক – আশাক আর লেখাপড়ার খরচ বাঁচিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা আদরের সন্তানের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যায় করে থাকেন ছোট-খাটো ব্যাবসায়ী বা চাকুরীজীবী পিতা-মাতা। নিশির বাবার ক্ষেত্রেও তাই , ব্যয় বাঁচিয়ে আয়ের একটা অংশ যে ব্যাংকে রাখবেন তার চিন্তা মাথায় আসলেও আর হয়ে ওঠেনা। মামুনির জন্য কিছু না নিয়ে গেলে যে কষ্ট পাবে ! সেটা সহ্য করা নিশির বাবা গফুর মিয়ার পক্ষে অসম্ভব নাহলেও কষ্টসাধ্য।
ফাগুনের রাত, ব্যবসা গুটিয়ে বাসায় আসছে গফুর , মাঘের শেষ হলো ঐ কিছুদিন , গায়ে শীত শীত লাগছে, মাঝে মাঝে কোকিলের কোহুতান আর জোনাকী পোকার আনাগোনা , দিয়াবাড়ির পাশদিয়ে হেটে আসছে, এখানে এখনো গ্রামেন আভা রয়ে গেছে, শিশিরে পা ভিজে যাচ্ছে হাটতে হাটতে। হাটছে আর ভাবছে গ্রামীন সেই দিনগুলো ! শৈশব আর কৈশরের ষোলআনা জুড়েই আছে গ্রামীন সেই সোনালী মূহুর্তগুলো, মনে মনে ভাবছে ছেলে মেয়েদের নিয়ে গ্রামে যাবে, পিতৃভূমি আর নিজের ভালো লাগার জায়গাগুলোতে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে ।
চিন্তা করতে করতে পথ শেষ হয়ে গেলো, গফুরের আনন্দের চিন্তাগুলো মাথায় আসলেই তা বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় ! আনন্দময় সেই ক্ষণ আর মূহুর্তুগুলো সব গফুরদেরই শেষ হয়ে যায় কারন এ চিন্তা যে মধ্যবিত্তের! নিশি মামুনি জেগে আছো ? আমি এসে গেছি , ইত্যাদি নানা আদরের স্বভাব সুলভ বাক্য বলতে বলতেই ঘরে ঢুকা। নিশি কোন দিন বাবা আসার আগে ঘুমাবেইনা, আজ ও তাই হলো , বাবা যেন তাকে ঘুম ভাঙ্গায় আর কোলে নেয় ! সাড়ে তিন বছরের মেয়েটা বাবার সমস্ত আনন্দের যেন মধ্যমণি । আহ্লাদে তার ১৬ আনাই পূর্ণ ।
বাবা – এইযে মা আমি তোমার জন্য কী নিয়ে আসছি দেখো । মেয়ে – আব্বু, তুমি না আমার জন্য লাল জামা আর লাল জুতো নিয়ে আসবা ? বাবা- সামনের মাসে তোমায় নতুন জামা পড়িয়ে গ্রামে নিয়ে যাবো, তুমি তো গ্রাম দেখনি।
সেখানে রাতের বেলা কোকিল ডাকে, জোনাকী পোকারা বাতি জালিয়ে অন্ধকারে খেলা করে, ঝিঝিপোকার শব্দে মাথা ধরে যাবে , অ¤্রমুকুলের মৌ মৌ গন্ধে তোমার মন ভরে যাবে ,ভোরে লতাগুল্মের শিশির কণাগুলো লক্ষ করলে দেখবে সাতটি রঙ্গের বৈচিত্র্যতা, দিনের বেলায়দেখবে বাহারী ফুলের সমারোহ, ইত্যাদি আরো নানা বিচিত্র সব ব্যপার দেখে তোমার ঢাকায় আসতেই মন চাবেনা ।
মেয়ে- আমি যাবো, বলো আব্বু মিস করবা না, প্রমিস ! বাবা – আমি কথা দিলাম, আল্লাহ বাঁচালে আমরা সামনের মাসেই যাবো।
বাবার গ্রাম সম্পর্কে নেশাজাগানিয়া কথা শুনে নিশি ঘুমাতে পারছেনা , শুধু এপাস-ওপাস করছে। প্রতিদিন বাবা আসলেই শুধু নতুন জামা পরে গ্রামে যাওয়ার বায়না, লাল জুতা আর লাল জামা পায়ে শিশির ভেজা মেঠো পথ দিয়ে হেটে যাবে, অবলীলায় মন ভরে দেখবে ভোরের শিশিরে ।
মন তার উড়ে বেড়ায় প্রজাপতির আকার
নিশিরে শিশিরে মিশে হবে একাকার ।
স্বপ্নপূরী হতে বাহারী পরীর দল
শিয়রের কাছে নেচেছে হেলিয়ে দুলিয়ে
হাতজোড় করে -বারবার শতবার সঙ্গে নিবি বল ?
যান্ত্রিক শহর ছেড়ে চল যাই পালিয়ে
যেথায় ভ্রমরের গুঞ্জন, কোকিলের কূহুতান-
হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে সচকিত হয়ে পুলকিত আঁখিতে
গ্রামে যাওয়ার শক্ত পণ, করেছে অবূঝ মন
মন ভুলানো দেশের তরে
না জানি কেন রে মন করছে আনচান !!
নিশি মামুনিটা বাবা আসার অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছে, বাবা আসলেন, নিরবে নিবৃতে আর নিঃশব্দে ! আগের মতো নেই সেই হাক-ডাক আর মধু ভরা শ্রæতিবান ! নিশির আম্মু কারণ জিজ্ঞেস করতেই মুখ ভার করে উত্তর – কিছু জানতে চেয়ো নাতো ? কাল থেকে বাসায় থাকবো তখন সব জানতে পারবে । ওমা একি কথা ? কি হয়েছে অন্তত এটুকু বলো ? গফুরের মুখে হাসি নেই কোন ছিটেফোটা এ যেন আকাশ কোণে কালো মেঘের ঘনঘটা !
গফুর – দেশের মধ্যে বিদেশী ছোয়াছে রোগ ঢুকে গেছে , ব্যবসা বন্ধ । নিশির মা – তাহলে চলার উপায় ? ঘরেও তো চাল বাড়ন্ত । গফুর- হাতে কিছু টাকা ছিলো ঐটা দিয়ে চলতে থাকি , আশাকরি , এই বিপদ অচিরেই কেটে যাবে। নিশির মা- তাই যেন হয় ।
নিশি ও তার বড় ভাই সব শুনছে কিন্তু বাবা বাসায় থাকবে শুনে তারা দুজনেই মহাখুশি। নিশি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আর বলে এখন থেকে বাবা বাসায় থাকবে , কি মজা, কি মজা । গফুর আঁচ করতে পারছে এ বিপদ সহজে কাটার নয় , তারপরেও মেয়ের আনন্দের কাছে নিজের বিষাদময় ভাবনাগুলোকে বিসর্জন দিয়ে ছেলে-মেয়ের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করছে , এভাবে দিনের পর দিন যাচ্ছে আর লকডাউনের পরিধিও বাড়ছে শুধু বাড়েনি গফুর মিয়ার জমানো শেষকটা টাকা দিয়ে কেনা চাল-ডালের পরিমান। কিছুদিন পর চালের সবশেষ দিয়ে রান্না হয়ে গেলো , গফুরের মাথায় বাজ পড়লো, কী করবে , কিছুই ভেবে পাচ্ছে না , এদিকে টিভিতে দেখছে – সরকার প্রধান মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সবাইকে সাহায্যের জন্য খাদ্য সামগ্রী মাঠ-প্রসাশনকে দিচ্ছেন এবং বলছেন – যারা হাত পাততে পারেনা সেই মধ্যবিত্তের খোঁজ নিয়ে তাঁদের বাসায় খাবার পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন কথায় গফুর মিয়া আশ্বস্থ হলেন, সে ভাবছে তার বাসায় আগামী কালই কেউ হয়তো খাবার নিয়ে আসবে ! এদিকে প্রতিদিনের মতো নিশি মামুনি আর গ্রামে যাওয়ার জন্য বায়না করেনা, বায়না করেনা লাল জামার , সেও তার বাবা- মায়ের শুকনো আর অসহায় মুখ দেখে সাহস পাচ্ছে না কিছু বলার , কিন্তু মন যে খুব করে চাচ্ছে গ্রামে যাওয়ার ! দুই- চারদিন নিশির মা পাশের বাসার ভাবিদের কাছথেকে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন, কিন্তু গফুর কোন উপায় পাচ্ছেনা কীভাবে ত্রান পাবে আর কীভাবেই বা লাইনে দাঁড়াবে, লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রান নিতে গেলে অনেকে আবার ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে, না না আমি না খেয়ে থাকবো , তাও ছবি ওঠবোনা ! আরো দুদিনে খেয়ে – না খেয়ে চল্লো।
এদিকে নিশি মামুনিটার জ্বর আসছে, কম খেয়ে খেয়ে শরীরও দূর্বল হয়ে পড়ছে তার, দুদিন হলো জল পট্টি আর মাথায় পানি দিয়ে কোন রকম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে চলেছেন নিশির মা। নিশিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, নিশিকে কোলে নিয়েই যাত্রা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে, এমন অসুস্থতার মাঝেই হঠাৎ প্রলাপ করে বলছে- আমি গ্রামে যাবো, পরীদের কথাদিয়েছি , ওখানে অনেক পাখি আর রাতের জোনাকী পোকাদের নিয়ে খেলবো ইত্যাদি নানা প্রলাপ , মাঝে মাঝে বলে উঠছে বাবা আমায় কী ওখানে নিয়ে যাচ্ছো ? বাবা নিশ্চুপ থেকে শুধু চোখের জল ফেলছে, তার চোখের জল সে ছাড়া আর কেউ দেখছেনা, লকডাউনে কোন যানবাহন নেই বাবার কোলই নিশির জন্য সবচেয়ে আরামের জায়গা। সাথে চলছে নিশির মা। হাসপাতালে ঢুকার মূহুর্তে গার্ড আর নার্সজ্বরের কথা শনে ঢুকতেই দিচ্ছে না, এক প্রকার ব্যার্থ সংগ্রাম করে অন্য হাসপাতালের দিকে ছুটছেন তাদের দেওয়া রেফারেন্সেই, এদিকে নিশি মামুনির শরীরের অবস্থা খারাপের দিকে ! হাটা শুরু করলো , হাটছেতো হাটছে যেন গহীনের পথ, চারিদিকে মনে হচ্ছে শব্দহীন ভয়ানক নিরবতা , যেন ছুটছে অসীমের দিগন্তে যেখানে নিশি মামুনি ভালো হবে চিরতরে !
আবার খেলবে , গলা ধরে চুমু খাবে আর নানা রকমের বায়না ধরবে ! মাইল তিনেক দূরে অন্য হাসপাতাল, আধামাইল যেতেই নিশির হাত পা শীতল হয়ে আসছে ! অনন্যোপায় হয়ে আল্লাহকে ডাকছে গফুর, হঠাৎ ভদ্রবেশি আদা-পাকাদাড়ি সমেত একজন ডাক্তার বিপরীত দিক থেকে আসছেন হাসপাতালের দিকে , ওদের দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন চলে যাচ্ছেন ? গফুর উত্তর দেয় , জ্বরের কথা শুনে গেট থেকে ফেরত দিয়ে সামনের প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে বলেছে, স্যার দেখেন , আমার মেয়েটা মনে হয় বাঁচবেনা , ডাক্তারের চোখ অশ্রæসিক্ত, তিনি তাদের নিয়ে হাসপাতালে ঢুকেন , দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু এর মধ্যেই নিশি সাড়া দিয়েছে গ্রামের লতাগুল্মের মাঝে জমে থাকা ভোরের শিশিরের ডাকে। মা-বাবা হতবম্ভ হয়ে পড়েন, একি হলো ! কান্নার রোল পড়ে যায় হাসপাতালে , চুপি চুপি চোখ মুচ্ছেন ডাক্তার মশাই সহ বাধা দেওয়া সেই নার্স ও আয়া সহ সিকোরিটি গার্ড । নমুনা টেস্ট করে দেখা গেলো নিশি শুধু জ্বরেই ভূগছিলো, শারীরিক দূর্বলতা আর সাময়িক হয়রাণী কাল হলো তার ।
নিশিরা আসে মধ্যবিত্তের অভিশপ্ত ঘরে
তিমির বিদীর্ণ করে আলো হবার তরে
কিন্তু হায়! আলো !! সে তো আলেয়ার খেলা
তারা জ্বেলে যায় আলোক শিখার দহন জ্বালা !
মোঃ আল আমিন প্রধান, শুল্ক কর্মকর্তা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।