সাইদুল ইসলাম সাঈদ
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকে কেবল ইতিহাসের পটে রেখে স্মরণ করলে তাঁকে আংশিক পাওয়া যাবে। তাঁকে পাওয়া ও বোঝা পূর্ণতা পাবে একই সঙ্গে তাঁর অর্জন ও অবদানকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করলে।
গ্রামের সাধারণ ঘরের একটি বালকের মধ্যে কিছু অসাধারণ গুণ দেখতে পাই।
ছেলেটি সে বয়সেই পরের হিতৈষী ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস ছিল তার, প্রয়োজনে দলবল নিয়ে প্রতিকারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাও তার ছিল।
এসব ঘটনায় প্রকাশ পাওয়া চারিত্রিক গুণাবলি তার ভবিষ্যৎ পরিণতির ইঙ্গিত দেয়।
ছেলেটা সাহসী,নেতৃত্বগুণের অধিকারী, ন্যায়ের প্রতি তার পক্ষপাত সহজাত এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধে সে আন্তরিক। পরে আমরা দেখতে পাই,অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়ও তিনি সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।
জুন ১৯৬৬ থেকে মার্চ ১৯৭১—এই ন্যূনাধিক পাঁচ বছরে দক্ষ সংগঠক ও তরুণ নেতা হিসেবে খ্যাত শেখ মুজিব তাঁর চেয়ে বয়সে প্রবীণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অগ্রসর কিংবা জেল-জুলুম খাটা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া সব নেতাকে ছাপিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
’৪৭ থেকে ছয় দফার আন্দোলনের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজনীতির নানা উত্থান-পতনে জর্জরিত ইতিহাস রাজনীতিকদের সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। বিপরীতে শেখ মুজিবের উত্থানপর্বের ইতিহাসে দেখি, জনমানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে পেল, রাজনীতিকে ঘিরে আশার আলো দেখতে শুরু করল। এভাবে জনগণের ঐকান্তিক ভালোবাসায় শেখ মুজিব কেবল বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন তা নয়, তিনিই জন-ইতিহাসের নেতা ও নায়ক হয়ে উঠলেন।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যখন রাজনৈতিক হাওয়া তপ্ত হতে শুরু করে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে কি না, সে সন্দেহ জোরদার হতে থাকে এবং পূর্ব বাংলার ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা পাকিস্তানবিরোধী স্বাধীনতার চেতনায় রূপ নিতে থাকে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আরও পোক্ত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
তিনি হয়ে উঠলেন জাতির আশা ও সংগ্রামের প্রতীক।
তাঁর নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা এত প্রগাঢ় হয়েছিল যে একদিকে স্বভাবত কোন্দলপ্রবণ বাঙালি সব বিবাদ ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল।
অন্যদিকে তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রাখতে পেরে মানুষ এতটাই উজ্জীবিত হয়েছিল যে সহজাত শান্তিপ্রিয় ও ঘরকুনো প্রকৃতির বাঙালি রূপান্তরিত হলো এক বীরের জাতিতে।
প্রকৃত বীরের মতোই তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত ছিল, ঠিক যেমন তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও প্রস্তুতি ছিল জাতির কল্যাণে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের। নেতা ও জনতার এই সম্মিলনের ফল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল—জনমনের পরিবর্তনের বিবেচনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা ঘটেছিল খারাপের দিকে। পাকিস্তানের নির্জন কারাবাস থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সম্পূর্ণ নতুন গৌরবের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তাঁর জনগণের মধ্যে যেন নয় মাসে এক অদৃশ্য ব্যবধান বা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। ক্রমে সেটা দৃশ্যমান হতে থাকল। একদল স্বাধীনতার মাধ্যমে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগকে নিজেদের পাতে টানার চেষ্টায় প্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।
তারা স্বভাবতই স্বাধীনতার কৃতিত্ব, মুক্তিসংগ্রামের উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার প্রসাদের ভাগ নিতে ক্ষমতাসীন দলেই আশ্রয় নিল।
আরেক দল স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে অঙ্কুরেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমে পড়েছিল। একাত্তরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় জাতীয় ঐক্য দেখতে পেয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় প্রবাসে আওয়ামী লীগের বিভক্ত বিবদমান অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষুদ্র একটি দলকে নিয়ে ভারতীয় ঝানু আমলা ও কূটনীতিকদের সহযোগিতায় যেভাবে কঠিন সময় সফলভাবে পাড়ি দিয়েছেন এবং এই সময়ে সমমনা দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে জাতীয় ঐক্যের ছাতাটি বহাল রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সে অভিজ্ঞতা সবার অনুধাবনের অবকাশ যেন বঙ্গবন্ধুসহ অনেকেই পাননি। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সেই ঐক্যের ধারাকে বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছিল, সেটার চেয়ে তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরই আস্থা রাখলেন। চিরকালের গণতান্ত্রিক নেতার পক্ষে সমাজের বিপ্লবী ক্রান্তিকালের চাহিদা অনুধাবন ও অনুসরণ সম্ভবত স্বাভাবিক ছিল না। বিভাজনে সৃষ্ট আস্থার সংকট ও অস্থিতিশীলতা সুযোগসন্ধানী ষড়যন্ত্রীদের সক্রিয়তার সহায়ক হয়েছিল। বাহাত্তরের ভুল বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন বাকশাল গঠন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্টে যেন বিষম কালো মেঘের ন্যায়, কুচক্রীমহল আর শত্রুর থাবা থেকে রেহাই পেলেন না বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার।
এই পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এবং বুঝতে বুঝতে ইতিহাসের পটে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে পঁচাত্তর আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিভাজনরেখা। কিন্তু তখন দিনে দিনে এটিও পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে কেবল আওয়ামী লীগ নয়, দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এ দেশের মানুষের প্রেরণার উৎস একজনই—তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু সংগঠনের কর্মী থেকে নেতা হয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেই যতি টানেননি, হয়ে উঠেছিলেন জাতির নেতা, জনগণের নায়ক, কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ইতিহাসের দায়—তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে কুণ্ঠিত হননি। তাঁর ভূমিকা বিশাল ও বৈচিত্র্যময়, তাঁর ব্যক্তিত্ব বহুমাত্রিক, তাঁর চিন্তা ও কর্ম ছিল লক্ষ্যাভিমুখী এবং ক্রমেই তাঁর রাজনীতি দেশ ও জাতির সামগ্রিকতায় বিকশিত হয়েছে।
সাইদুল ইসলাম সাঈদ,
ছাত্রলীগ কর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।