নিজস্ব প্রতিবেদক
রায়ে আমৃত্যু উল্লেখ না থাকলে যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরসুপ্রিম কোর্টযাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারাভোগ করতে হবে বলে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ বছরের সাজার বিষয়টিও বিবেচনায় আসবে।আজ মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ভার্চুয়াল বেঞ্চ এই রায় দেন।
আদালত বলেছেন, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত। তবে বিচারিক (নিম্ন) আদালত যদি ৩০ বছরের সাজা দেন সেক্ষেত্রে ৪৫, ৫৩ এবং ৫৫ ও ৫৭ এই ধারাগুলা একসাথে বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু ৩০ বছরের সাজার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা পাবে না।
ভার্চুয়াল আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্ত ছিলেনন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। আর আসামি পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইনজীবী শিশির মনির।আপিল বিভাগের রায়ের বরাত দিয়ে আইনজীবী আসাদ উদ্দিন বলেছেন, যদি কোনো আদালত রায় ঘোষণার সময় যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু উল্লেখ করে দেন তা হলে আসামিরা সেই সুবিধা পাবেন না।
তবে যে সকল রায়ে আদালত যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু উল্লেখ করেননি তাদের ক্ষেত্রে জেলকোড অনুযায়ী বিভিন্ন রেয়াত পূর্ণ হলে ৩০ বছর পর সাজা খাটা ব্যক্তি মুক্তি পাবে।এর আগে গত মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) এ বিষয়ে শুনানি শেষ হয়। ওইদিন আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে যুক্ত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।গত বছরের ১১ জুলাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে শুনানি শেষে সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) রেখেছিলেন।
তখন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন।গত বছরের ১১ এপ্রিল এ মামলায় চারজন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে আইনি সহায়তাকারী) নিয়োগ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। তারা তাদের মতামত তুলে ধরেন।অ্যামিকাস কিউরিরা হলেন-ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এএফ হাসান আরিফ, আব্দুর রেজাক খান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন।তখন শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যাবজ্জীবন সাজার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকতে হবে। আমাদের আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হিসেবে ৩০ বছর বলা আছে। যা রেয়াত পাওয়ার পর সাড়ে ২২ বছর হয়।
উন্নত বিশ্বেও সাজার মেয়াদ বলে দেওয়া হয়। সেখানে প্যারোল ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড প্রাপ্তদের দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা নেই। তাই যাবজ্জীবন হিসেবে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলে কারাগারগুলো বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাবে।উল্লেখ্য, ২০০১ সালে সাভারে জামান নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০০৩ সালে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টে আপিলের পর বিচারিক আদালতের দণ্ড বহাল থাকে।
এর বিরুদ্ধে আপিলের পর ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আসামিদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সর্বোচ্চ আদালত।রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাবাস’ এমন মন্তব্য করেন বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তবে ওই দিন অন্যান্য মামলার আসামির ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে কিনা? সে বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, সবার ক্ষেত্রে এ রায় প্রযোজ্য হবে কিনা, সেটি পূর্ণাঙ্গ রায় না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।একই দিন খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রায়ের সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু (ন্যাচারাল লাইফ) কারাবাস। তখন আমি এর প্রতিবাদ করেছি।
‘আমি বলেছিলাম, দণ্ডবিধির ৫৭ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ ৩০ বছর। এছাড়া যাবজ্জীবনের আসামিরা কারাগারে রেয়াত পেয়ে দণ্ড আরও কমে আসে। যদি আমৃত্যুই হয়ে থাকে, তাহলে তাদের রেয়াতের কি হবে? আমি আরও বলেছিলাম, প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্য যেন মূল রায়ে না থাকে। তবে যদি থাকে, তাহলে সব আসামির ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে।ওই দিন সে সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, সাভারের একটি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
তবে আদেশে বলেছেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর নয়, আমৃত্যু কারাদণ্ড। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর।২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ মামলার ৯২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশিত হয়। পরে ২০১৭ সালের ০৫ নভেম্বর আতাউর রহমান মৃধার আইনজীবী ওই রায়ের রিভিউয়ের কথা সাংবাদিকদের জানান। পরে রিভিউ করেন আতাউর রহমান মৃধা।এদিকে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেন, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী দোষী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, এটাই বিধান। এক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডটা হচ্ছে ব্যতিক্রম। যখন এ ধরনের পরিস্থিতিতে কাউকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তখন এর কারণ অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।
দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ ৪৫ ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড।আদালত আরও বলেন, যদি হাইকোর্ট বিভাগ বা এ আদালত (আপিল বিভাগ) মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন তখন এবং নির্দেশ দেন যে তার স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত এ কারাদণ্ড ভোগ করবেন, তখন এ ধরনের মামলায় সাজা কমানোর আবেদন গ্রাহ্য হবে না।আদালতের এ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপরাপর আসামির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র সচিব ও কারা মহাপরিদর্শককে বলা হয়।ওই রায়ের পর যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা বিভ্রান্তিতে ছিলেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ আমৃত্যু কারাদণ্ড, নাকি ৩০ বছর কারাদণ্ড হবে, নাকি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত আসবে, তা জানা গেল এ সর্বোচ্চ আদালতের আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তির অবসান ঘটলো মনে করেন আইনজীবীরা।