মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
আজ পহেলা নভেম্বর। বিচার বিভাগ পৃথককরণ দিবস। ২০০৭ সালের এই দিনে বাংলাদেশে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করা হয় বিচার বিভাগ। আজ এক যুগের বেশি সময় পার হলো সেই পৃথককরণের। এটি বিচারক তথা বিচার বিভাগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিবস। এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ও জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি আমরা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেকোনো গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে পায় নতুন সংবিধান। সেই সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার প্রতিফলন।
দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র তা-ই করে। অন্যান্য বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের আধিপত্য, যা ব্রিটিশ আমল থেকে দৃশ্যমান, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কাম্য নয়। দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয়, বরং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন বিভিন্ন সময়ে তাঁর রাজনৈতিক সভার ভাষণে প্রত্যক্ষ করা যায়। ১৯৭২ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথককরণের (Separation of Power) উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকার ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা যাক-
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আমি হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতগুলো যাতে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমি এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করতে চাই যে, দুর্নীতি ও কালক্ষেপণ উচ্ছেদ করার প্রেক্ষিতে বিচারব্যবস্থার কতকগুলো মৌলিক ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নীতি সূক্ষ্মভাবে পর্যলোচনা করা হবে।’
বিচার বিভাগের পৃথককরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আধিপত্য কমে যেতে পারে- এ আশঙ্কায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে কিছুটা গড়িমসিও দেখা যায়। যা-ই হোক, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং বর্তমান সরকার ও তার আইনমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
সত্যিকার অর্থে সরকারের কোনো বিভাগের মধ্যে আধিপত্য কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একটি বিভাগের প্রভাব বিস্তার নয়, বরং সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিজ নিজ বিভাগের কার্য সম্পাদনে তৎপর ও উদ্যোগী হলেই সুশাসন অনেকটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। সমসাময়িক ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে কোনো বিভাগ যদি নিজ বিভাগের পদমর্যাদা বাড়ানোর জন্য অন্য বিভাগ তথা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে, তবে তা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে গণ্য হয়। সরকারকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় এবং সব রাষ্ট্রীয় অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দেশ পরিচালনা করতে হয়।
সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক মঞ্চে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন. ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।
আইনের ব্যাখ্যাদান ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বোঝায়। তবে বিচারকদের এ ধরনের স্বাধীনতার অর্থ কোনোভাবে তাদের অবাধ কিংবা যা খুশি তা-ই করার ক্ষমতাকে বোঝায় না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পাশাপাশি সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিচারকদের দায় বহুলাংশে বেড়ে গেছে।
বিচারকের সঙ্গে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি সাংঘাতিকভাবে জড়িত। জ্যাকবীয় যুগের (১৫৯৭) শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী ফ্রান্সিস বেকন তাই বলেছিলেন, ‘আদালতে প্রতিটি অভিযোগ কোনো না কোনো ব্যক্তির অধিকারের প্রশ্নসম্পৃক্ত। ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বিচারপ্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত অনুরাগ যদি বিচারককে অপরাধীর পক্ষ নিতে প্ররোচিত করে, তবে তার উচিত সুনির্দিষ্ট রায় না দিয়ে বিষয়টিতে সমঝোতার মাধ্যমে ফয়সালার পদক্ষেপ নেওয়া।’
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের আপোষহীন ও বিবেকবান হতে বলেন ফ্রান্সিস বেকন, ‘বিচারকদের হতে হবে সিংহের মতো।’ সিংহাসনের ছত্রছায়া তাদের ওপর থাকবে, কিন্তু বিচারককে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হতে হবে অবিচল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংবিধানে বিচার বিভাগকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানবিরোধী বিধি-বিধানকে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ে পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ রাষ্ট্র্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ২২-এ বলা হয়েছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথককরণের বিধান সম্পর্কে। ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। (Article 22 of the Constitution provides that the State shall ensure the separation of judiciary from the executive organs of the State.)।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান প্রবর্তন থেকে সে সকল আইন ততখানি বাতিল হবে।’ অর্থাৎ সংবিধান আমাদের বিচার বিভাগকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বিচারকদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ও ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। (116A. Subject to provisions of the Constitution, all persons employed in the judicial service and all magistrates shall be independent in the exercise of their judicial functions.) অর্থাৎ সংবিধানের বিধানমতে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
তাদের নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘বিচারবিভাগীয় পদে বা বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে বিচারকার্যে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি ও ন্যায়বিচার প্রলম্বিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা চলে যায় স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে এবং সামরিক শাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সংবিধান বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়। ২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইচ্ছামতো বিচার বিভাগকে সাজাতে চেয়েছে। অবশেষ স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর অরাজনৈতিক ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিদ্ধান্তে আপন পথ ফিরে পায় বিচার বিভাগ। জাতির জনকের সময়ে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের এই বাস্তব রূপদান ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যাকে দেশের বিচারাঙ্গনসহ সব স্তরের জনগণ সাধুবাদ জানায়।
বিচার বিভাগ স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ২০০৭-২০০৮ সালে বেশ কিছু আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটে। যেমন- বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা ২০০৭, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে স্কেল-২০১৬ ইত্যাদি। এ ছাড়া অধস্তন আদালতগুলোর শৃঙ্খলা বিধানসহ একটি আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
সবচেয়ে যুগান্তকারী সংশোধনী আনা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ। এই আইনের ০৬ ধারায় দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করা হয়। এক পক্ষে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যপক্ষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭-১৪৮ ধারা, ১৭৬ ধারাসহ আরও কিছু ধারা যেমন ২৯(বি) ধারায় কার্যক্রম পরিচালনা ও দ- প্রদানের ক্ষমতাসহ মোবাইল কোর্ট ২০০৯ এর অধীনে বাংলাদেশে প্রচলিত ১১৯টি (২০১৯ পর্যন্ত) আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্টেটরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
বিচার বিভাগের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা মূলত বিচার বিভাগ পৃথককরণ নীতির বাস্তবায়ন। জনগণ ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ পৃথককরণের সুফল টের পাচ্ছে। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
বিশ্বের মধ্যম আয়ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের দেশে নির্বাচিত সরকার, আইন পরিষদ ও জাতির পিতার হাতে গড়া দেশ ও বিচারব্যবস্থার নিরিখে দেশে গণতন্ত্রকামী জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা পূরণ করার উপযোগী পরিবেশ বিদ্যমান। তার পরও বাস্তবে আইনের শাসনের প্রতিফলন ঠিক সে রকম ফলাও করে লেখার মতো নয়। বোধ করি সে কারণে এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে জাতির জনক বলেছিলেন, ‘আমরাও বিচার বিভাগকে একই উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।’ তিনি মনে করেন, আমাদের মতো দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যাদের কাছে থাকে, তারা প্রায়শই ভুলে যান যে তাদের সে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশের প্রচলিত আইন ও আইন প্রতিষ্ঠানের অধীন।
যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, তবে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন শক্তিশালী ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেদিক বিবেচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা শুধু স্বাাধীন বিচার বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক (Separation of Power) হওয়াটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম মাত্র।
বিচার বিভাগের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়া যেসব উদ্যোগ ও অনুষঙ্গের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিচারকদের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা। তারা যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে শক্ত অবস্থান নেন তবে পৃথককরণের সুফল মিলবে তাতে সন্দেহ নেই।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন। জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিচার বিভাগের পৃথককরণ নীতি তাঁর সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হবে। তারা আরও আশা করে, বিচার বিভাগ যাতে সামগ্রিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বদা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার সার্বিক সহযোগিতা এবং বিচার প্রশাসনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (Sustainable Development Goal) অর্জনে বদ্ধপরিকর।
সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক মঞ্চে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগ পৃথক মানে যে কতগুলো পৃথক ভবন, পৃথক নিয়োগ কাঠামো, পৃথক কর্মচারী, পৃথক ওয়েবসাইট এবং পৃথক একটা সমিতি যেমন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বিষয়টি ঠিক তেমন নয়।
বঙ্গবন্ধু বিচার বিভাগের যেমনটি স্বাধীনতা দেখতে চেয়েছিলেন সেটা হলো সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় হবে, বিচার বিভাগের জন্য বাজেট প্রণয়নের বিচার বিভাগই প্রধান দায়িত্ব পালন করবে, এক্সিকিউটিভ এবং লেজিসলেচার বিচার বিভাগ নিয়ে কখনোই কোনো মাথা ঘামাবে না, বিচারকদের চাকরি, শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদিতে মন্ত্রণালয়ের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, পৃথক একটি প্রসিকিউশন সার্ভিস হবে, পৃথক একটি তদন্তকারী সংস্থা হবে। তবে কিছুই হচ্ছে না, সেটিও বলা যাবে না। যেমন বিচারকদের জন্য ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, আলাদা ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি প্রতিষ্ঠা, পৃথক বেতন কাঠামো, পৃথক নিয়োগ, বিচারকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা মোটা দাগে বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। পৃথক সচিবালয়ও হবে এবং পৃথক একটি প্রসিকিউশন সার্ভিস হবে, পৃথক একটি তদন্তকারী সংস্থা হবে।
বিচার বিভাগের পৃথককরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আধিপত্য কমে যেতে পারে- এ আশঙ্কায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে কিছুটা গড়িমসিও দেখা যায়। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং বর্তমান সরকার ও তার আইনমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লেখক: কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক।