বেল্লাল হোসাইন :
সাংবিধানিক আইনের স্বচ্ছ ধারণা না থাকার ফলে অনেকেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা-বিবৃতিতে বারবার সংবিধান লংঘনের অভিযোগ তোলেন। চলুন দেখে আসি কী আছে সংবিধানের এই বিতর্কিত অংশে।
সংবিধান কেমন আইন?
সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সুপ্রিম আইন। সংসদ যেসব আইন প্রণয়ন করে তা সংবিধানের মূলনীতি বা মতবাদের সাথে অসামঞ্জস্য পূর্ণ হতে পারেনা। সংবিধানের চেতনা ও নীতি বিবর্জিত যেকোনো আইন বা আইনের অংশ সংবিধানের অভিভাবক হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল ঘোষণা করতে পারে। যেমন পঞ্চম ও অষ্টম সংবিধান সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তাহলে বলা যায় সংবিধান হলো দিকনির্দেশনামূলক আইন যা অন্যান্য আইন কেমন হবে সে ব্যাপারে গাইডলাইন দিয়ে থাকে। যেমন সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচারবিভাগ পৃথকীকরণের বিধানের কথা একলাইনে লেখাআছে। কিন্তু কীভাবে পৃথক হবে, কাদের নিয়ে হবে, কারা নিয়ন্ত্রণ করবে ইত্যাদি স্পষ্ট করে লেখা নেই। সংবিধান যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আইন/ বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। এই আইন প্রণয়ন ক্ষমতা হস্তান্তরকে “ডেলিগেটেড লেজিসলেশন” বলে। আইন যখন প্রণীত হয় তখন শর্ত একটাই তা সংবিধানের মৌলিক বিধান ও চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। যেমন বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচারকদের ব্যাপারে সরকার কোনোরকম ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্টের সাথে বিনা আলোচনায় গ্রহণ করতে পারবেনা। যদিও ইদানিং দ্বৈতশাসনের অনুযোগ তোলা হয়, তথাপি সুপ্রিম কোর্টের মতামত অগ্রগন্য।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি :
বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ৮ থেকে অনুচ্ছেদ ২৫ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানে ধারাবাহিক ভাবে নিম্নোক্ত নীতিগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে –
৮. মূলনীতিসমূহ ৯. জাতীয়তাবাদ ১০. সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি ১১.গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ১২. ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ১৩. মালিকানার নীতি ১৪. কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি ১৫. মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা ১৬. গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষিবিপ্লব ১৭. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ১৮. জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা ১৮(ক). পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ১৯. সুযোগের সমতা ২০. অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম ২১. নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য ২২. নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ ২৩. জাতীয় সংস্কৃতি ২৩ (ক) . উপজাতি, ক্ষুদ্রজাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ২৪. জাতীয় স্মৃতি নিদর্শন, প্রভৃতি ২৫. আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের সময় ভারত, কানাডাসহ কিছু দেশের সংবিধানের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করা হয়েছে। তাই আমাদের সংবিধানে তাদের কিছু বিষয়বস্তুর মিল পাওয়া যায়।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি মামলা করে বলবৎ করা যায় না কেন?
সংবিধানের ৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যাবেনা। অর্থাৎ এই অংশটুকুর ভিত্তি যতটানা আইনি তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ইচ্ছা শক্তির বিকল্প নেই।
সংবিধানের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু উদ্ধৃত করা হলো –
“এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ- পরিচালনার মূল সূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎ যোগ্য হইবে না৷”
বলবৎ যোগ্য না হলে সংবিধানে বিধান থাকার যৌক্তিকতা কী?
মূলনীতিগুলো হলো এমন কিছু লক্ষ্য যা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হবে এবং সেই ভিত্তিতে তাদের একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে উদ্বুদ্ধ করবে। ইহাকে একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বলেও আখ্যায়িত করা যায়। রাষ্ট্র ও নাগরিকগণ তাদের আর্থ সামাজিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন ও স্বপ্নগুচ্ছ পূরণে যে পলিসি গ্রহণ করে এবং সেগুলো অর্জনে সচেষ্ট থাকে তার মূলভিত্তি হবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮ থেকে ২৫ পর্যন্ত উদ্ধৃত নীতিসমূহ।
রাজনৈতিকদলগুলোকে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হয়। জনগণের উপরও যেহেতু এই নীতিমালা বাস্তবায়নের দায় সাংবিধানিকভাবে বর্তায় তাই তাঁরাও সেই সব দলকেই বেছে নিতে চায় যারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তর্ভূক্ত মৌলিক প্রয়োজনের(খাদ্য,বস্ত্র,চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন) ব্যবস্থা, বাধ্যতামূলক বিনামুল্যের শিক্ষা,বিদ্যুতায়ন ও পল্লীউন্নয়ন , কর্ম লাভে সুযোগের সমতা ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা দেয়ার অঙ্গীকার করে ও বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকে।
বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ সালে। সংবিধান প্রণয়ণের প্রায় পাঁচ দশক পর ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশে এখন প্রায় বিরানব্বই শতাংশ লোক বিদ্যুৎ সেবার আওতাধীন এসেছে (তথ্যসূত্রঃ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট)। প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষা সরঞ্জামাদি ও বিনামূল্যে সরবারহ করা হচ্ছে। সীমিত আকারে ভিজিএফ কার্ডের আওতায় খাদ্যসামগ্রী বিনামূল্যে সরবারহ করা হচ্ছে। এখন এইসব সুযোগ সুবিধা যদি মামলা করে সরকারকে বাধ্য করে আদায় করা যেত তবে সরকার নিশ্চিতভাবেই বেকায়দায় পড়ে যেত। কারণ আমাদের সম্পদ সীমিত। রাষ্ট্র পরিচালনার সব নীতি সবার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকার মহা আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে যাবে।
সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের বিচারবিভাগ পৃথকীকরণের বিধান কার্যকর করা হয় ২০০৭ সালে। অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা ধাপে ধাপে অর্জিত হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি যে শুধু বাংলাদেশের সংবিধানেই আছে এমন নয়। উন্নত বিশ্বের বহুদেশে জন প্রত্যাশার প্রতীক হিসাবে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিগুচ্ছ রাখা হয়। অন্যান্য দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিকে বিল অব রাইটস, ডিরেকটিভ প্রিন্সিপালস ইত্যাদি নামে ডাকা হলেও সারবস্তু আসলে একই। এই নীতিসমূহ দেশে শাসন ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহীরা জনৈতিক দলগুলোকে নৈতিকভাবে বাধ্যবাধকতার মোড়কে আটকে ফেলে যাতে তাঁরা জনগণের স্বপ্নপূরণের সারথি হয়। আইনিভাবে কার্যকর করা না গেলেও ভোট চাইতে গেলে এই দাবীসমূহ পুরণের ওয়াদা ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ দখল করা সম্ভব নয়। তাইবলা যায়, জনগণ তাৎক্ষনিকভাবে এর ফলাফল ঘরে তুলতে নাপারলেও, পরোক্ষভাবে নীতিসমূহ জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখে।
এভাবেই ধীরে ধীরে সব নীতিই বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা যায়। একদিন হবেই হয়তো।
লেখক : আইনজীবী ও সমাজকর্মী, ই-মেইল : bellal.sincere@gmail.com
- বিষয়:ফিচার