ধরে নিন আপনার বয়স ৫৮ বছর। আপনার হাসিখুশী আনন্দময় জীবনে হঠাৎ নেমে এসেছে এক দূর্ঘটনা৷ আপনি স্ট্রোক করেছেন৷ আপনি আইসিইউতে শয্যাশায়ী ৷ আপনার মস্তিষ্কের রেসপন্স খুবই সামান্য পাচ্ছেন কৰ্তব্যরত চিকিৎসকরা। আপনার চোখের উপর আলো ফেলছেন কিছুক্ষণ পরপর চিকিৎসক৷ আপনার চোখের রিয়েকশন কমে আসছে। চিকিৎসক চিন্তিত৷
আপনার মস্তিষ্কের ভেতর স্মৃতিকোষগুলো চিরতরে ঘুমিয়ে যাবার আগে পুরোনো স্মৃতিগুলো হাতরিয়ে নিচ্ছে ৷ এটাই হয়তো শেষবার, সর্ব শেষবার!
আপনি হঠাৎ অনুভব করলেন, আপনার পাশে দাঁড়ানো আপনার স্নেহের দুই সন্তান ৷ আপনার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে যাবার আগে শুনছে আপনার সন্তানদের কথোপকথন, আপনাকে নিয়ে তাদের ভাবনা। আপনার এক সন্তান বলছে তার ভাইকে, বাবার আশা ক্ষীণ৷ ডাক্তারও তেমন আশাবাদী নন৷ কি করবি ভাইয়া?
আপনার বড় সন্তান বলছে, ভরসা দিতে পারছে না তো ডাক্তাররা৷ দেখি আর এক দুই দিন, কি বলিস তুই? আম্মাকে বলা যাবে না। কান্নাকাটি করবে। আব্বার বয়স হয়েছে, আর কষ্ট না পাক আব্বা৷ আমি এটাই চাই৷
আপনি ধরে নিবেন আপনি এখন আশাহীনের দলে চলে গেছেন । আপনাকে নিয়ে আপনার আপনজনরাই বড়জোড় ৪৮ ঘন্টা পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। আপনি আত্মসমর্পণ করেছেন স্রষ্টার করুণার কাছে। আপনাকে নিয়ে আপনার সন্তানরা চিন্তিত, আপনাকে তারা কষ্ট দিতে চায় না ৷ অর্থাৎ তারা চায় আপনার ব্যথাহীন অন্তিম পরিণতি।
আপনি চিৎকার করে বলতে চাচ্ছেন, “না বাবা হাল ছাড়িস না তোরা! আমি তোদের জন্য কখনও হাল ছাড়িনি। আমি বাবা হিসেবে কতো শ্রম দিয়েছি, কখোনো ঘন্টার হিসেব করিনি, তোরা অসুস্হ্য হলে কখোনো বলিনি- ৪৮ ঘন্টা দেখবো৷ আমার প্রতি তোরা এতো নিষ্ঠুর হবিনা৷ কিন্তু আপনি বলতে পারছেন না ৷ আপনার হার্ট বিট বাড়ছে, ঘনঘন শ্বাস পড়ছে ৷ আপনি চাচ্ছেন বুঝাতে – আপনি কষ্ট পেয়ে হলেও বাঁচতে চান।”
প্রকৃতি আজ আপনার উপর রূঢ় হয়েছে৷ আপনাকে সুযোগ দিতে চায়না আর ৷ আপনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, বড় ডিগ্রীধারী, বিশিষ্ট সমাজপতি৷ এসব প্রকৃতির কাছে এখন নস্যি!
আপনার জীবনের মূল্য আর ঐ রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা দ্বিগম্বর লুলু পাগলের জীবনের মূল্য প্রকৃতির কাছে একই। প্রকৃতি ইনজাস্টিস করেনা, করতে পারেনা।
আপনার মস্তিষ্ক আবারো রিলে করা শুরু করলো৷ নিজেকে প্রশ্ন করছেন, কি নিয়ে আমি অসীমের দিকে যাত্রা করবো? আপনি অনেকের অভিশাপ ও বদ দোয়া গায়ে মাখিয়েছেন। জীবদ্দশায় বিজনেস পার্টনারের প্রাপ্য লভ্যাংশ মেরে দিয়েছেন, অফিসের ম্যানেজারকে তার হক হতে বঞ্চিত করেছেন। এই তো কিছুদিন আগেও আপনার ড্রাইভার রহিমকে বলেছেন, শুয়োরের বাচ্চা, গাড়ি ঠিকমতো মুছিস নি কেনো? ড্রাইভার চুপ করে বললো, মাফ করে দেন স্যার৷
আপনি এখন বুঝেছেন রহিম করিম যদু মধু শ্যাম এদের কাছে মাফ চাওয়া জরুরী, কিন্তু তারা তো আজ এখানে নেই৷ আপনি যে জমকালো বাড়ি বানিয়েছেন, তার অন্দরমহল আপনার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরেই ৷ আপনার সন্তানরা চাচ্ছেন আপনার চিরবিদায়, তারা রিস্ক নিতে চায়না, ভদ্রভাবে আপনার সামনেই একভাই আরেক ভাইকে বললো উঁহু ! বাবাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা ৷ এটা ডিপ্লোম্যাটিক কথা। একভাই আরেক ভাইয়ের কাছে নিজেকে জাস্টিফাই করলো।
দিন শেষে আপনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, ধন সম্পদ, প্রতিপত্তি, বাহাদুরী সব এখন অৰ্থহীন৷
আপনি অনুভব করলেন, সবই প্রকৃতির চক্র৷ যতোক্ষণ মানুষের জীবন, যতোক্ষণ মানুষ অর্থের জোগান দাতা, ততোক্ষণই আপনার মূল্যায়ন!
আপনি অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করলেন, আমার নিজের কি আছে?
আপনার আত্মা নিঃশ্চুপ৷ বুঝলেন আপনার ব্যক্তিগত আমল বা পরকালের সঞ্চয় একেবারেই শূন্য।
আপনি ভুলে গিয়েছিলেন আপনার ফুসফুসের ৫০০ মিলি বাতাস দিয়ে আপনি চলতেন, ঐটুকু বাতাসের উপর ভর দিয়েই আপনার হৃৎপিন্ড ধুকধুক করতো ৷ সেই বাতাসটুকুর শক্তি এখন শেষের পথে।
আপনি আর ঐ ড্রাইভার রহিম আজ প্রকৃতির কাছে সমান। দুজনের মধ্যে কোন পাৰ্থক্য নেই৷ বরং ড্রাইভার রহিম আপনার চেয়ে এগিয়ে। সে দারিদ্র পীড়িত৷ কারো প্রতি অবিচার করেনি, কাউকে ঠকায়নি।
এসব ভাবতে ভাবতেই আপনি শুনলেন ডক্টর চিৎকার করে উঠলো, সিস্টার হার্টবিট কমে যাচ্ছে! এড্রেনালিন রেডি করেন৷ ডিসি শক তৈরি করেন।
আপনার মস্তিষ্ক শুধু কুয়াশা দেখছে এখন ৷
কুয়াশার মধ্যেই আপনার ড্রাইভার রহিম দাঁড়িয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘স্যার! আমি শুয়োরের বাচ্চা ছিলাম না, আমি গরীব, কিন্তু আমিও মানুষ৷ আপনি হাত জোড় করে ক্ষমা পেতে চাইছেন, কিন্তু আপনার পক্ষে তা আর সম্ভব নয়।”
সিপিআর চলছে, আপনার বুকে একের পর এক ডিসি শক চলছে।
আপনার হার্ট বিট কমে আসছে …… ৬০…. ৫৩……. ২৩ ………. ১৩ ….. ৷৷ পরিশেষে অাপনার ভোগ বিলাসের জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
সৌজন্যেঃ
ডাঃ আসিফ সৈকত
আইসিইউ বিশেষজ্ঞ