ঘটনাপ্রবাহ-১: জঙ্গীদের হামলায় দুই বিচারক নিহত
২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর। জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ঝালকাঠির দুই বিচারক নিহত হন। সেদিন সকাল নয়টার দিকে সরকারি বাসা থেকে জেলা জজ আদালতে যাওয়ার পথে দুই বিচারককে বহনকারী মাইক্রোবাসে হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ এবং বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে।
ঘটনাপ্রবাহ-২: ছুরি নিয়ে বিচারকের খাস কামরায় আসামী!
১৫ জুলাই, ২০১৯। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফাতেমা ফেরদৌসের আদালতে মনোহরগঞ্জ উপজেলার কান্দি গ্রামে ২০১৩ সালের ২৬ আগস্ট সংঘটিত আবদুল করিম হত্যা মামলায় (মামলা নং-১৩) আসামি আবুল হাসান (২৫) ও ফারুক হোসেন (২৭) হাজিরা দিতে আসেন। আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে ওই হত্যা মামলার আসামি আবুল হাসান হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তার সহযোগী আসামি ফারুক হোসেনকে ছুরিকাঘাত করেন। ফারুক দৌড়ে বিচারকের খাস কামরায় গিয়ে আশ্রয় নিলেও হাসান ওই কামরায় গিয়ে ফারুককে আবারও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। এতে ফারুক মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় আদালতের পুলিশ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা হাসানকে ধরে ফেলেন।
ঘটনাপ্রবাহ-৩: এক রাতে টাঙ্গাইলের চার বিচারকের বাসায় হামলা
৪ জানুয়ারি ২০২০। টাঙ্গাইল আদালতের চার বিচারকের বাসায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা হানা দেয়। বিচারকদের বাসায় ঢুকে তছনছ করলেও চোর কিছু নেয়নি। পুলিশ জানায়, টাঙ্গাইল শহরের হাউজিং এলাকায় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মাসুম, সুমন কুমার কর্মকার ও আমিনুল ইসলাম এবং জেলা জজ আদালতের সহকারী জজ মুজিবুর রহমান পৃথক পৃথক বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। সেই রাতে কে বা কারা আবদুল্লাহ আল মাসুম, সুমন কুমার কর্মকার ও মুজিবুর রহমানের বাসার দরজার তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। তারা বাসার মালামাল তছনছ করে। অপর বিচারক আমিনুল ইসলামের বাসার গ্রিল কেটেও ঢোকার চেষ্টা করার আলামত পাওয়া যায়। তবে কারও বাসা থেকে কোনো মালামাল খোয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ চোরের দল ঘরের ভেতরে ঢুকে আলমারি ভেঙে জিনিসপত্র বের করে নিচে ফেলে দেয় এবং বাসার সব মালামাল তছনছ করে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নগদ টাকা এবং মূল্যবান জিনিস থাকা সত্ত্বেও তারা কোনো কিছু নেয়নি। এ কারণে ঘটনাটি রহস্যজনক।
ঘটনাপ্রবাহ-৪: রাজশাহীতে চার বিচারকের বাড়িতে চুরি
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। রাজশাহীর যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজের বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটে এদিন সন্ধ্যায়। তার আগে নগরীর রাজপাড়া থানা এলাকায় বসবাসকারী আরও দুই বিচারকের বাসায় চুরির ঘটনা ঘটে। ফলে রীতিমতো বিচারকদের মাঝে চুরির আতঙ্ক দেখা দেয়। নগরীর মিঠুর মোড় এলাকায় যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের ভাড়া বাড়ির তালা ভেঙে চোরেরা স্বর্ণালংকার, ল্যাপটপ ও নগদ লক্ষাধিক টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যায়। এর আগেও প্রায় একই কায়দায় চুরির ঘটনা আরো দুই বিচারকের বাড়িতে ঘটে। সবকটি ঘটনায় নগরীর রাজপাড়া থানায় লিখিত অভিযোগ হয়েছে। পুলিশ অভিযোগগুলো মামলা হিসেবেও গ্রহণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় কোনো চোরকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ফলে একের পর এক চুরির ঘটনায় বিচারকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে। অতি সম্প্রতি নগরীর বোয়ালিয়া থানাধীন এলাকায় বসবাসরত রাজশাহী চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতেও ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটেছে।
রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানা এলাকায় হলো আদালত চত্তর। এই আদালত চত্ত্বর এলাকার আশে-পাশেই বিভিন্ন মহল্লায় অন্তত ৫০ জন বিচারক বসবাস করেন। কিন্তু এসব বিচারকদের জন্য বাড়তি কোনো নিরাপত্তা দেয় না পুলিশ। যার কারণে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটে বিচারকদের বাড়িতে।
উপেক্ষিত বিচারকদের নিরাপত্তা
এভাবেই সারা দেশে চরম অনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছেন বিচারকরা। রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর একটি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে বিচারকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিচারকদের সেই অর্থে কোনো নিরাপত্তাই নেই।
জানা যায়, ফৌজদারি মামলার বিচারকগণ হত্যা, ধর্ষণ ও মাদকের মামলাসহ রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে নিয়মিত আদেশ দেন। এছাড়াও দেওয়ানি মামলার বিচারকগণ ভূমি ও চাকুরি সংক্রান্ত বহু মামলায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর আদেশ দেন। এসব আদেশে নিয়মিতভাবেই কোনো একটি পক্ষ বিচারকদের ওপর সংক্ষুব্ধ হয়। যে-কারণে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি রাষ্ট্রের স্বার্থেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে বিচারকদের কোনো নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। বিচারকদের নিরাপত্তা বলতে কেবল এতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে যে, আদালতে যাতায়াতকালে বিচারকদের বহনকারী মাইক্রোবাসে একজন গানম্যান থাকেন। অন্যসময় বিচারকদের গণপরিবহণ ব্যবহার করতে হয়। সেসময় থাকে না কোনো নিরাপত্তকর্মী। বিচারকদের সব এজলাসেও পুলিশ বা আনসার মোতায়েন থাকে না।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচারকদের ওপর হামলা ও বিচারকদের বাড়ি লক্ষ্য করে চুরির ঘটনাগুলো থেকে বিচারকরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন, তার চিত্র মেলে।
কিন্তু এতসব ঘটনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চাকারী বিচারকদের নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না।
বিচারকদের নিরাপত্তা নিয়ে করা রিটের অগ্রগতি নেই
কুমিল্লায় বিচারকের এজলাসে আসামীর ছুরিসহ প্রবেশের ঘটনার পর সারা দেশের বিচারকদের নিরাপত্তা চেয়ে রিট করেন এক বিচারকের স্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
সেই রিটে সারা দেশের আদালতে আইনজীবী, বিচারক ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে চান হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কুমিল্লার ঘটনায় যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাও জানাতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে নির্দেশ দেন আদালত।
কুমিল্লার আদালতের এজলাসে এক আসামির ছুরিকাঘাতে অপর আসামি নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচারকদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত চেয়ে করা এক রিট আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী ইশরাত জাহান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
আদালত বলেন, কুমিল্লার পর মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্ট বারেও ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় কোর্টে আইনজীবী, জাজ ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য কী পদক্ষেপ নিলেন। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, কুমিল্লা ও সুপ্রিমকোর্ট বারের দুটি ঘটনাই ব্যক্তিগত।
এ সময় আদালত বলেন, ব্যক্তিগত হোক, আর যাই হোক, কোর্টের ভেতরে ছুরি নিয়ে কীভাবে যায়? পুলিশ কী করে? ডেফিনেটলি এটি পুলিশের নেগলিজেন্স। তখন আবেদনকারী আইনজীবী বলেন, নিরাপত্তা তো সবার জন্য। উনিও (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। তাই আইনজীবী, বিচারকসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর আদালত ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সারা দেশের আদালতে আইনজীবী, বিচারক ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা এবং কুমিল্লার ঘটনায় যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানাতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে নির্দেশ দেন। সে পর্যন্ত রিট আবেদনটি স্ট্যান্ডওভার (মুলতবি) রাখেন। রিট আবেদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যা ব মহাপরিচালককে বিবাদী করা হয়।
বিচারকদের নিরাপত্তায় যেসব উদ্যোগ আশু জরুরি
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিচারক জানান, বিচারকদের প্রতিটি এজলাসে এই মুহূর্তে পুলিশ মোতায়েন প্রয়োজন। সর্বস্তরের বিচারকদের গাড়িসহ গানম্যান সরবরাহ করা জরুরি। এছাড়াও প্রতিটি জেলায় বিচারকদের পৃথক কোয়ার্টার নির্মাণ করে পুলিশ গার্ডের ব্যবস্থা করা দরকার। জেলা জজ পদমর্যাদার সকল বিচারক, সিএমএম, সিজেএম এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজদের সরকারি বাসভবন নির্মাণ করে তাদের সার্বক্ষণিক পুলিশি নিরাপত্তা বিধান করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
অপর এক বিচারক নামপ্রকাশ না করার শর্তে আরও জানান, জনগণ মনে করেন এবং আশা করেন যে, বিচারকরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধা এবং নিরাপত্তা পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঝুঁকি বিবেচনায় আমাদের রাষ্ট্রে বিচারকরাই সবচে বেশি নিরাপত্তাহীন। তিনি বলেন, একজন পুলিশ সুপার বা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের পৃথক সরকারি বাড়ি ও সার্বক্ষণিক পুলিশি নিরাপত্তা থাকলেও জেলার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির প্রধান চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো সরকারি বাসভবন বা সার্বক্ষণিক পুলিশি প্রহরা নেই। সব পর্যায়ের বিচারকরা রাষ্ট্রের অত্যন্ত স্পর্শকাতর কাজের সঙ্গে জড়িত হলেও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, বিচার করার জন্য সাহসের প্রয়োজন হয়। নিরাপত্তাবোধ না থাকলে সাহসী হওয়া কঠিন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থেই বিচারকদের নিরাপত্তা সবচে গুরুত্ব পাওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।