জাতীয় সংসদে আজ সোমবার পাস হতে যাচ্ছে অর্থ বিল। করোনাভাইরাসের ধকল সামলে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সুপারিশকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থ বিলে সংশোধনী আনা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর সংসদে এমপিদের (সংসদ সদস্য) ও বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের আলোচনার বিভিন্ন সুপারিশ উঠে আসে। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাপ্ত ৫১টি সুপারিশ পর্যালোচনা করে বেশ কয়েকটি বিষয় শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে প্রস্তাবিত বাজেটটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য আরও কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বাজেটকে জনকল্যাণমুখী করতে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
গত ১১ জুন সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ১৫ জুন সম্পূরক বাজেট পাস হয়। আজ অর্থ বিল পাস করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাজেট ঘোষণার পর সংসদে এমপিদের ও বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের আলোচনার উঠে আসা সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। সংসদ থেকে ৫১টি সুপারিশ পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে বেশকিছু খাতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, যেসব খাতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। এতে একজন গ্রাহকের ১০০ টাকা রিচার্জের বিপরীতে ৩ টাকা বাড়তি ট্যাক্স-ভ্যাট ১১ জুন থেকে কাটা শুরু করে মোবাইল অপারেটগুলো। ব্যাপক সমালোচনার পর মোবাইলসেবার সম্পূরক শুল্ক আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ আগের মতো ১০০ টাকায় ৭৮ টাকার টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবেন ভোক্তা। বাকি ২২ টাকা সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট হিসেবে পাবে। এছাড়া ভ্যাট আপিলের ক্ষেত্রে বর্ধিত জমার পরিমাণ শিথিল করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ও আপিল কমিশনারেটে ভ্যাট আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে তর্কিত আদেশের দাবিকৃত করের ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ অর্থ জমার প্রস্তাব করা হয়, যা আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। অযৌক্তিক ভ্যাট মামলা দায়েরের প্রবণতা হ্রাসে এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ব্যবসায়ী মহল এর তীব্র বিরোধিতা করে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, এ উদ্যোগ ব্যবসা পরিবেশ সহজীকরণ ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এটি ব্যবসায়ীদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালকে সংকুচিত করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে জমা আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব কর্মকর্তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তল্লাশিতে ‘স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা’ দিয়ে ভ্যাট আইনে নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। নতুন উপধারায় বলা আছে, রাজস্ব কর্মকর্তারা নিজ এখতিয়ারাধীন এলাকায় কোন নিবন্ধিত, নিবন্ধনযোগ্য ব্যক্তির উৎপাদনস্থল বা সরবরাহস্থল বা সেবা প্রদানস্থল বা ব্যবসাস্থল পরিদর্শন এবং মজুদ পণ্য, সেবা, উপকরণ ও হিসাব পরীক্ষা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে কমিশনারের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। এই উপধারা সংশোধন করা হচ্ছে। রাজস্ব কর্মকর্তাদের তল্লাশির ক্ষমতা বহাল রেখে তল্লাশির আগে ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে কমিশনারের অনুমোদনক্রমে সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা তল্লাশি চালাতে পারেন।
এছাড়া আমদানিকৃত পণ্যের বিল অব এন্ট্রি পাঁচ দিনে জমার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে কাস্টমস আইন সংশোধন করা হয়। মূলত বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও অনেক আমদানিকারক বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন না। এর ফলে অনেক সময় জাহাজজট তৈরি হয়। আবার এ কারণে কনটেইনার জটও তৈরি হয়। এ জটিলতার নিরসনে কাস্টমস আইনে ধারা যুক্ত করা হলেও ব্যবসায়ীদের দাবি ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এই শর্ত প্রত্যাহার হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত কাঁচামাল চার মাসের মধ্যে ব্যবহার না করা হলে ভ্যাট রেয়াত বাতিল সংক্রান্ত প্রস্তাবও প্রত্যাহার হতে পারে।
সম্প্রতি এনবিআরে পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়ার সঙ্গে সরবরাহকারী, সরবরাহকারী ব্যাংক, শিপিং এজেন্ট, এলসি অ্যাপ্লিকেন্ট ব্যাংক, কুরিয়ার সার্ভিসসহ আরও কয়েকটি পক্ষ জড়িত থাকে। এছাড়া এলসিতে (ঋণপত্র) ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে, যা সরবরাহকারীর চাহিদামাফিক দিতে হয়। আবার কখনো কখনো জাহাজ আগে আসে কিন্তু ডকুমেন্ট পরে আসে। এটাই বাস্তবতা এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
সূত্রগুলো বলছে, আয়কর খাতে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না। রেওয়াজ অনুযায়ী, বাজেটের সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা দিকনির্দেশনা দেন। তার ভিত্তিতে আইনগত পরিবর্তন আনা হয়। এবারও প্রধানমন্ত্রী দিকনির্দেশনা দেবেন। তাতে কোম্পানির প্রচার ব্যয়সীমা নির্দিষ্টকরণ ও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের সীমা থাকতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা যুক্ত করে কোম্পানির প্রচার ব্যয়ের সীমা বার্ষিক টার্নওভারের দশমিক ৫০ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের সীমা টার্নওভারের ১ দশমিক ২৫ শতাংশের পরিবর্তে দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়। বাজেট ঘোষণার পর দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দুটি ধারার পরিবর্তনের জোর দাবি জানায়।