দুই আসামির যাবজ্জীবন, তিনজনের খালাস
পরিকল্পনাকারী খালাস পায় কীভাবে, প্রশ্ন মেয়ের
সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালে পারিবারিক দ্বন্দ্বে গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যার দায়ে দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার তৃতীয় বিশেষ দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন বুধবার আসামিদের উপস্থিতিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
সাজা পাওয়া দুই আসামি হলো– ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এদিকে অভিযোগপত্রে পারিবারিক বিরোধের কথা থাকলেও অপরাধের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি তিন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। তারা হলেন– সগিরার ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন ও মন্টু মণ্ডল। আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা মারুফ ও আনাসকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা তিন আসামিও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ের পর সাজার পরোয়ানা দিয়ে দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
খালাস পাওয়া আসামিদের রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করবে বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই মামলায় দু’পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে গোঁজামিলের রায় দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে সগিরার মেয়ে সামিয়া সাবা চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল ছয় বছর। আমার মাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন। তারা রায়ে খালাস পেয়ে গেছেন। পরিকল্পনাকারী কীভাবে খালাস পায়? আমরা রায়ে সন্তুষ্ট না। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। তিনি বলেন, তিন দশক ধরে হত্যা ঘটনাটি চাপা রাখা হয়েছিল। মূল পরিকল্পনাকারীদের খালাস দিয়ে রায় হলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে। মামলার বাদী সগিরা মোর্শেদের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী বলেন, রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। দু’জনের রায়ে সন্তুষ্ট, আর দু’জনের রায়ে সন্তুষ্ট নই। আমরা আপিল করব।
আসামি পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষ্যে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি আসেনি। মামলার বাদীও সাক্ষ্যে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি উল্লেখ করেননি।
প্রেক্ষাপট
মামলা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেলে সগিরা মোর্শেদ রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়ে সারাহাত সালমাকে আনতে যান। সিদ্ধেশ্বরী রোডে ঢুকতেই মোটরসাইকেলে আসা আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সগিরা মোর্শেদ।
ওই ঘটনায় রমনা থানায় অচেনা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তাঁর স্বামী সালাম চৌধুরী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত হিসেবে মন্টু ও মারুফ রেজাকে শনাক্ত করলে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলায় সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। সাক্ষ্য চলাকালে মারুফ রেজার প্রসঙ্গ উঠে আসায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালের ২৩ মে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন ঢাকার জজ আদালত। সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা মারুফ রেজা এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের সমন্ধির ছেলে।
এর পর বিচারিক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন উচ্চ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছিল আসামি পক্ষ। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের নির্দেশে পিবিআই আদালতের জিআর শাখায় এ অভিযোগপত্র জমা দেন। ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর সগিরা মোর্শেদের ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, জা সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এদিকে, মামলার তদন্তে নেমে পিবিআই জানতে পারে, ভাড়াটে খুনি মারুফ রেজা মামলা স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করে। সেখান থেকে পুনরায় তদন্ত শুরু করে পিবিআই। তদন্তের পর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তারা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে উঠে আসে সগিরা মোর্শেদকে কীভাবে হত্যা করা হয়।