গত মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুর পরে দেশে প্রথমবারের মতো প্রাণঘাতী মাদক এলএসডি বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথ্যালামাইড উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হয় ঢাবির ওই শিক্ষার্থী নিয়মিত এলএসডি সেবন করতেন। আর এলএসডি সেবনের কারণেই বোধশক্তি হারিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
এ ঘটনার পর থেকে এলএসডি নিয়ে কাজ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই মাদকের ব্যবহার কীভাবে হয়, কোথা থেকে আসে, কারা নিয়ে আসে, কারা সেবন করে এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মাঠে নামে পুলিশ ও র্যাব। মাঠে নামার কয়েকদিনের মধ্যে সফলতাও পায় পুলিশ।
গত মে মাসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পৃথক তিনটি অভিযানে এলএসডি সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে নতুন মাদকটিও জব্দ করা হয়। গ্রেফতাররা সবাই রাজধানীর বেশ কয়েকটি নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, এই মাদকটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে। দাম অনেক বেশি হওয়ায় এলএসডি এখন পর্যন্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের হাতের নাগালে রয়েছে। এছাড়া এলএসডি সেবনকারীদের অধিকাংশই রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে তারা এই মাদকের ব্যবসা চালাচ্ছিল।
গত ৩০ মে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগ থেকে জানানো হয়, এলএসডি সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পাঁচ জনকে রাজধানীর ভাটারা ও খিলগাঁও থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেছে বলে জানায়।
এ বিষয়ে মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আ. আহাদ বলেন, রাজধানীতে প্রায় ১৫টি গ্রুপ রয়েছে, যারা বিদেশ থেকে এলএসডি আনা শুরু করে বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে জড়িত। এলএসডি কেনাবেচা সংক্রান্ত সব তথ্য এই গ্রুপগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় পেজের মাধ্যমে আদান-প্রদান করে। এই পেজগুলোও শনাক্ত করা গেছে।
১৫টি গ্রুপের মধ্যে একটি গ্রুপের ৫ জনকে মতিঝিল বিভাগ পুলিশ গ্রেফতার করতে পারলেও বাকিদের হদিস নেই। গ্রুপগুলো শনাক্তের দুই মাস পার হয়ে গেলেও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়া পেজগুলোর খোঁজ আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া গেলেও সেগুলোর কোনো হদিস পাচ্ছে না পুলিশ। গ্রুপগুলো হঠাৎ করে কীভাবে উধাও হলো, তা তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।
ডিএমপির মতিঝিল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারে পুলিশ। তথ্য মতে, এলএসডি কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত গ্রুপগুলোর পেজ নজরদারিতে নিয়ে আসে তারা। কিন্তু এক সপ্তাহ পর থেকেই পেজগুলো অনলাইন প্লাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আরও বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে এলএসডি কেনা বেচার সঙ্গে জড়িত গ্রুপগুলোর এডমিনদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। তাদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এলএসডি সেবন ও কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা প্রযুক্তির দিক দিয়ে খুবই পারদর্শী। তাদের গ্রুপের কয়েকজনকে গ্রেফতার হতে দেখে তারা কিছু পেজ বন্ধ করে দেয় এবং কিছু পেজ নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে, গ্রুপগুলো আগের পেজ বন্ধ বা নিষ্ক্রিয় করে নতুন পেজ খুলে এলএসডি কেনাবেচা করে থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট সাইবার মনিটরিং চালিয়ে যাচ্ছে।
এলএসডির গ্রুপগুলোর বিষয়ে মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আ. আহাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলএসডি সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত যেই ১৫টি গ্রুপ আছে, আমরা সেগুলো শনাক্ত করেছিলাম। কিন্তু এখন তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনলাইনে যেসব পেজের মাধ্যমে গ্রুপগুলো ব্যবসা করত, তারা সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের এখন তেমন কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
যেভাবে দেশে গড়ে উঠছে এলএসডির বাজার
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত এক থেকে দেড় বছর আগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক প্রচারণার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এলএসডির প্রতি আকৃষ্ট হন। তারা কৌতূহলবশত অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডির সেবন প্রক্রিয়া ও কোথায় পাওয়া যায় সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে এলএসডি দেশে নিয়ে আসা ও সেবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। পরে তারা বিদেশ থেকে এলএসডি দেশে নিয়ে এসে গ্রুপে আলোচনা করে কেনাবেচার বিষয়টি ঠিক করেন। এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া ১৫টি গ্রুপের সদস্য নিজেরাই এলএসডির ক্রেতা ও বিক্রেতা। এসব গ্রুপের বাইরে এলএসডির বিক্রির তেমন কোনো তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কোথা থেকে আসছে এলএসডি
ডিবি সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণে এলএসডি দেশে এসেছে তা মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশীয় সেবনকারীরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ওইসব দেশের ব্যবসায়ীদের পে-পালে টাকা পাঠিয়ে এলএসডি অর্ডার করেন। কুরিয়ার ও ব্যাগেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশে এলএসডি ঢুকছে। পরে সেবনকারীরা বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ থেকে তা সরবরাহ করছেন।
এলএসডি সেবনের ভয়াবহতা
ডিবি ও ডিএমপির মতিঝিল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এলএসডি মাদক যদি কোনো মানুষ তার জিহ্বার নিচে দেয়, তাহলে শরীরের এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সেবনকারীরা স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য জগতে চলে যায়। ইয়াবা, ফেনসিডিল কিংবা হেরোইনের চেয়ে এলএসডির নেশা আরও ভয়ানক। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।
লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড বা এলএসডি এক ধরনের তরল। ভারতের অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর এ মাদকটি আলোচনায় আসে। তার বিরুদ্ধে এ মাদক নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
এলএসডি অত্যন্ত দামি একটি মাদক। সাধারণত ব্লটিং পেপারের ওপরে এই তরল মাদক ফেলে সেই কাগজ শুঁকে নেশা করে মাদকাসক্তরা। এলএসডি মাখা এক-একটি ছোট ছোট টুকরো ব্লটিং পেপারের দাম কয়েক হাজার টাকা।
১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে একে নিষিদ্ধ করা হয়।
বিজ্ঞানীরা জানান, এলএসডি ব্যবহার করলে মানুষের স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে যায়। নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ মাতৃগর্ভের স্মৃতিও মনে করতে পারেন। তবে সে সব স্মৃতির ভার অধিকাংশ মানুষই সহ্য করতে পারেন না। ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অধিকাংশ মাদকগ্রহণকারীই স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে প্রবেশের আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এলএসডি গ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই এমন দাবি করে থাকেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যালুসিনেশনই এসব অনুভূতির মূল কারণ।