গৃহিনী তামান্না তান্নি নিয়মিত ফেইসবুক ব্যবহারকারী। প্রতিদিনকার মতই ফেসবুক চালানোর সময় বন্ধুর দেওয়া একটি লিংকে ঢুকে দেখলেন কয়েক মিনিটে তিনি জিতে যেতে পারেন আইফোন। সেই সুযোগ হাতছাড়া না করতেই কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন।
আরেহ বাহ, নোটিফিকেশন এলো তামান্নার মোবাইলে মাত্র ২০জন বন্ধুকে এই লিংকটি শেয়ার করলেই সে জিতে যেতে পারে পুরস্কার। তাই আর দেড়ি না করে সে লেগে গেলো শেয়ার কর্মে। ব্যস, নিজের অজান্তেই তামান্না হয়ে গেলেন একজন স্প্যামার। আর এভাবেও একজনের থেকে অন্যজনের সোশাল মিডিয়া ইনবক্সে স্প্যাম বা ফিশিং লিংকগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া এসব লোভনীয় অফারের ফাদে পা দিয়ে নিজের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের পাশাপাশি হাতে বা ঘরে থাকা স্মার্ট ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণও হারাতে পারেন ব্যাবহারকারী। যার মাশুল খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু ব্র্যান্ডের নামে নানা লোভনীয় অফার বা উপহার জিতে নেওয়ার সুযোগ সংবলিত পোষ্ট লিংক ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করা হচ্ছে। এসব লিংকে ক্লিক করলেই দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ধাপে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ব্যবহারকারীকে উপহার জেতার সম্ভাবনা প্রবল এমন একটি বার্তা প্রদর্শন করা হচ্ছে। এরপর নতুন একটি লিংক জেনারেট করে বলা হচ্ছে সেই লিংকটি ২০ জন বন্ধুকে থবা ৫টি গ্রুপে শেয়ার করতে। তাহলেই পুরস্কার জিতে নিতে পারবেন। তবে এখন পর্যন্ত এসব পুরস্কার কেউ হাতে পেয়েছেন তেমনটি নিশ্চিত করা যায়নি।
এই ইস্যুতেই গত কয়েকদিনে আলোচনায় উঠে এসেছে দেশীয় চেইন সুপারশপ স্বপ্ন’র নামও। ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে উপহার দিচ্ছে স্বপ্ন এমন একটি লিংক ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে এমন কোন অফারের ঘোষণা স্বপ্ন থেকে দেয়া হয়নি বলে অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির হেড অফ মার্কেটিং মোঃ মাহাদী ফয়সাল। তিনি বলেন, দেশের স্বপ্ন’র লোগো হুবুহু নকল করে কে বা কারা “স্বপ্ন’র ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী” লিখে নানা অফারের কথা সাজিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ইনবক্সে লিংক পাঠাচ্ছে। তবে এটি একটি ফেইক পোস্ট। স্বপ্ন থেকে এই ধরণের কোন অফার ঘোষণা করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই এই বিষয়ে আমরা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি এবং পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগে অফিসিয়ালি একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছি।
এমন লিংকগুলো ব্যবহারকারির তথ্য চুরি বা ডিভাইসের নিয়ন্ত্রন নিতে সক্ষম জানিয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিশ্নেষক জেনিফার আলম ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, সাধারনত হ্যাকারদের বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ সম্পর্কে আমরা জানি কিন্তু সচেতনতার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। যদি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বা চলমান একটা বিষয় লক্ষ্য করেন একটি ফেইক লিংক যেটি একটি স্বনামধন্য ব্রান্ডের ইমেইজ ব্যবহার করে ছড়ানো হচ্ছে। আমরা সবাই জানি অনেক সময় বিভিন্ন ব্রান্ড বা কোম্পানি অনেক ধরনের লোভনীয় অফার নিয়ে আসে কাস্টমারদের আকৃষ্ট করতে সেই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়েই হ্যাকাররা বিভিন্ন ফাঁদ পেতে থাকে যেটাকে ফিসিং লিংক বা ম্যালিসিয়াস লিংকও বলা হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে লিংক বা ইউআরএল-টি আসল কি না, আমরা যাচাইয়ের জন্যে গুগলে সার্চ করে দেখতে পারি আসল লিংক কোনটি।
এসব লিংকে ক্লিক করলে কি কি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে জেনিফার বলেন, এই লিংকগুলোতে ক্লিক করার পরে ব্যবহারকারীর অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে পরতে পারেন। যার মধ্যে আমরা ৪ টা সমস্যাকে প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করি। এগুলো হচ্ছে-
১/ ব্যবহারকারির সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।
২/ ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ডের যাবতীয় তথ্য হ্যাকাররা নিয়ে নিতে পারে।।
৩/ ম্যালিসিয়াস লিংকে ক্লিক করার মাধ্যমে আপনার ডিভাইসে ম্যালওয়্যার ইন্সটল হয়ে যেতে পারে, এতে করে ব্যবহারকারীর সম্পূর্ণ ডিভাইসটি হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। সেটা মোবাইল হউক বা কম্পিউটার ডিভাইস।
৪/ হ্যাকাররা ব্যবহারকারীর পিন পয়েন্ট লোকেশন নিতে পারে ও ডিভাইসের ক্যামেরা অন করে লাইভ দেখতেও পারে।
সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ডিএমপি, উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম সুমন, আইসিটি, টেক নিউজ, ইত্তেফাক, আজকের খবর, বাংলাদেশের খবর, আইসিটি নিউজ, tech news, bdtech news, Ict news, Ittefaq, ভুয়া অফার, ফেক লিংক, স্প্যাম লিংক, এই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম সুমন ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, অফারের নামে যে অবৈধ লিংক দিয়ে যেই অ্যাড ছড়ানো হচ্ছে, তা খারাপ উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি ছড়াচ্ছে। এই লিংক কখনও অ্যাডওয়ার বা ম্যালওয়ার হিসেবে কাজ করে, ফোনের অ্যাটাক করে ডেটা প্রাইভেসি হ্যাক করতে পারে।
এই ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার, খুব প্রয়োজন না হলে এইসব লিংকে ক্লিক না করাই ভালো। যদি একান্তই ক্লিক করতে হয়, তাহলে লিংকটি ব্রাউজারে ফেলে , ভালো করে অ্যানালিসিস করে তারপর ক্লিক করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এসব কার্যক্রম বন্ধে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে আমরা লিংকগুলোর উৎস খুজে বের করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি এই লিংকগুলো যদি বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করার সুযোগ থাকে তাহলে আমরা সেগুলো বন্ধ করে দেই। এরপর অভিযুক্তদের আটক করে বিধান অনুযায়ী তাদের শাস্তি দেওয়া হবে।
এইরকম কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে কি ধরণের শাস্তি হতে পারে সেই বিষয়ে নাজমুল ইসলাম বলেন, কম্পিউটারে অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা, গোপনে ঢোকা, হ্যাকিং, তথ্য ধ্বংস, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো ইত্যাদি ইস্যুতে ১৮, ২৪, ২৫ বা ৩৪ ধারায় তাদের শাস্তি হতে পারে।