চন্দন কান্তি নাথ
বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে মক্কেলের নিয়মিত বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান হয় |তাঁকে আদালতে মক্কেলের পক্ষে বলতে হয় |কাগজ জমা দিতে হয় |আইনগত ভাবে তিনি কত টুকু বলতে বাধ্য এবং না বললে আইন গত ভাবে তিনি কত টুকু দায়ী |প্রসঙ্গত যদি আইনজীবী কে বলতে হয় তিনি তাঁর বক্তব্যে ও কাগজ পত্র এর জন্যে আইন গত ভাবে দায়ী থাকবেন |তিনি কিভাবে দায়ী থাকবেন |ডিজিটাল মাধ্যমে আবেদনে যদি আইনজীবী বলেন – ‘আমি এই মর্মে প্রত্যয় করছি যে , আবেদনের সাথে দেয়া সকল তথ্য সঠিক ও সংযুক্তি সঠিক |অসত্য প্রমাণিত হলে আইনগত ভাবে আমি দায় বদ্ধ থাকবো’ তাহলে আইনত আইনজীবী কে কত টুকু দায়ী করা যাবে |আইনজীবীর অধিকারই বা কোথায়? আইন কি বলে? এক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের ধারা ১২৬,১২৭ এবং দি বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনারস এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস,১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্ট এন্ড এটিকেট’ প্রাসঙ্গিক |
ধারা ১২৬ এ পেশা সম্পর্কিত বার্তা শিরোনামে আছে – ‘ ব্যারিস্টার, এটর্নি বা উকিল মক্কেলের ব্যারিস্টার, এটর্নি বা উকিল হিসাবে কাজ করবার সময় এবং উদ্দেশ্যে উক্ত মক্কেল কর্তৃক বা মক্কেলের পক্ষ হতে তাঁর নিকট প্রদত্ত কোন বার্তার বিষয় (to disclose any communication made to him in the course) মক্কেলের অনুমতি ব্যতীত প্রকাশ করতে অনুমতি পাবেন না। অথবা বৃত্তিগত কার্য সম্পাদানকালে এবং প্রসঙ্গে মক্কেলের যে সকল দলিলের সাথে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন , ( to state the contents or condition of any document with which he has become acquainted in the course) সেগুলির বিষয়বস্তুু বা অবস্থার কোন বিবৃতি দিতে পারবেন না অথবা তাঁর কার্যকালে ও উদ্দেশ্যে মক্কেলকে তিনি যে পরামর্শ দিয়েছেন , তা প্রকাশ করতে পারবেন না।
তবে তিনি যা প্রকাশ করতে পারবেন তা হলো |(১) বেআইনী উদ্দেশ্যে সাধনকল্পে যে সংবাদ আদান-প্রদান করা হয়েছে (any such communication made in furtherance of any illegal purpose) (২) ব্যরিস্টার, এটর্নি বা উকিল পেশাগত কার্যে নিযুক্ত থাকবার সময় তৎকর্তৃক লক্ষিত বিষয় যা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর নিযুক্তির পরে কোন অপরাধ বা প্রতারণা সংঘটিত হয়েছে (any crime of fraud has been committed since the commencement of his employment) | অনুরূপ ঘটনার প্রতি উক্ত ব্যরিস্টার, এটর্নি বা উকিল মনোযোগ তাঁর মক্কেল কর্তৃক বা মক্কেলের পক্ষ হতে আকৃষ্ট করা হয়েছিলো কিনা গুরুত্বপূর্ণ নয় (was or was not directed to such fact by or on behalf of his client) |এই বাধ্যবাধকতা নিযুক্তির অবসান ঘটবার পরও অব্যাহত থাকে।উদাহরণ হিসাবে উক্ত ধারা তে আছে – মক্কেল ক এ্যাডভোকেট খ-কে জানায় ‘আমি জালিয়াতী করেছি এবং আমি চাই যে, আপনি আমার পক্ষে মামলা পরিচালনা করুন’।ব্যক্তিকে দোষী জেনে ও তাকে প্রতিরক্ষা করা যেহেতু অপরাধমূলক কার্য নয় , সেহেতু উপরোক্ত সংবাদ প্রদানের গোপনীয়তা সংরক্ষিত।
আবার মক্কেল ক এ্যাডভোকেট খ-কে জানায় ‘আমি একটি জাল দলিল ব্যবহার করে সম্পত্তি দখল নিতে চাই এবং আমার পক্ষে এ বিষয়ে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি’।অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে সাধনকল্পে এই সংবাদ প্রদান করা হয়েছে বলে এর প্রকাশ নিষিদ্ধ নয় ।একই ভাবে তহবিল তছরূপের দায়ে অভিযুক্ত ক তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করার জন্য এ্যাডভোকেট খ-কে নিযুক্ত করলেন। মামলা চলাকালে খ লক্ষ্য করলেন যে, তছরূপকৃত পরিমাণ অর্থ ক-এর নিকট হতে আদায় দেখিয়ে হিসাব খাতায় একটি হিসাব লেখা হয়েছে যা তাঁর নিযুক্তির আরম্ভতে লেখা ছিল না।যেহেতু এটি এমন একটি ব্যাপার খ তাঁর কার্যকালে লক্ষ্য করেছেন এবং এটি দ্বারা মামলা চলতে থাকাকালে প্রতারণা করা প্রতীয়মান হয়েছে, সেহেতু এর প্রকাশ নিষিদ্ধ নয়।
আবার উকিল দের কেরানীর জন্যে ও একই আইন প্রযোজ্য হবে, উক্ত আইনের ধারা ১২৭ এ আছে, ” দোভাষী এবং ব্যরিষ্টার, উকিল ও এটর্নিগণের কেরানী বা কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও ১২৬ ধারার বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে।”
একই রূপ ধারা ১২৯ এ ‘আইন উপদেষ্টার সাথে গোপন বার্তার আদান প্রদান’ শিরোনামে আছে – কোন ব্যক্তি ও তাঁর পেশাদার আইন উপদেষ্টার মধ্যে গোপনীয় বার্তার আদান-প্রদান হয়ে থাকলে, সে ব্যক্তি যদি মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ না করেন, তবে সে গোপনীয় আদান-প্রদানের বিষয় আদালতে প্রকাশ করতে তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। যদি তিনি সাক্ষ্য প্রদান করেন, তবে তাঁর দেওয়া সাক্ষ্যের ব্যাখ্যার জন্য উক্ত গোপনীয় বার্তা আদান-প্রদানের বিষয় আদালতের জানা প্রয়োজন হলেই কেবল তাঁকে তা প্রকাশ করতে বাধ্য করা যাবে। অন্য কিছু নয় ।আবার দেওয়ানি কার্য বিধি আইনের ধারা ২ (১৫) তে আছে, ‘উকিল বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যিনি অপরের পক্ষে আদালতে হাজির হওয়ার ও যুক্তিতর্ক পেশ করার অধিকারী’ অনুরূপ ফৌজদারি কার্য বিধি এর ৪ ধারাতে ও প্রায় একই রূপ বক্তব্য আছে|
আমাদের সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ৩৩(১) এ আইনজীবী দের উপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে |সেখানে আছে, “….. এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের….. অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।”আবার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪০ এ আইনজীবীর পেশার অধিকার কে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে |তাতে আছে – ” আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হয়ে থাকলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকবে।” কিন্তু অনুচ্ছেদ ৪০ কিংবা ৩৯ এ আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে পেশা গ্রহণ কিংবা চিন্তার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে |অনুচ্ছেদ ৩৯ এ আছে, “….. কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং…. নিশ্চয়তা দান করা হল।”আবার জাতিসংঘ মূলনীতিতে (ইউএন বেসিক প্রিন্সিপাল অন রোল অফ ল ইয়ার) পেশাগত জীবনে আইনজীবীর প্রাপ্য অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিগুলোর সারসংক্ষেপ রয়েছে। ১৯৯০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কিউবার রাজধানী হাভানায় অনুষ্ঠিত ‘অপরাধ প্রতিরোধ ও অপরাধীর চিকিৎসাবিষয়ক জাতিসংঘ কংগ্রেস’-এর ৮ম অধিবেশনে এই মূলনীতি সর্বোসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
তাই আদালতে আইনজীবীদের অধিকার যেমন আছে তেমনি দায় দায়িত্ব আছে |Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972 যেমন এর ১৯ (১) ধারা তে আছে, ” (1) Save as otherwise provided in this Order, no person shall be entitled to practise the profession of law unless he is an advocate. (2) Subject to the provisions of this Order, the rules made thereunder and any other law for the time being in force, an advocate shall be entitled as of right to practise throughout Bangladesh, and to appear, act and plead before any court, tribunal or revenue authority in Bangladesh. উক্ত ধারার ” subject to the provisions…. any other law for the time being in force” দিয়ে বুঝা যায় আইন আইনজীবী আইন সঙ্গত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে আদালত এ প্র্যাক্টিস পারবেন |আবার সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে আছে, সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য৷ একজন আইনজীবী একজন নাগরিক হিসেবে আইন অনুসারে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক |গত ২৭. ১২. ২০১৯ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন “এ পেশায় শুধু আইনের ওপরই দখল থাকলে চলবে না। পেশাগত আচরণ সুন্দর হতে হবে।
সর্বোপরি অবশ্যই তাকে সৎ হতে হবে, এবং উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে। কোনো বিচার নিষ্পত্তির সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আর এ কারণে ব্যক্তিগত স্বার্থের চাইতে আদালতের প্রতি কর্তব্য ও মক্কেলের প্রতি সেবার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনা করতে হবে।”আবার দি বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনারস এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস,১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্ট এন্ড এটিকেট’ নামের বইটিতে প্রকাশিতএডভোকেটদের জন্য অবশ্যই অনুসরণীয় আচরণবিধির অধ্যায়-১ এ আইনজীবীদের প্রতি আচরণ ১-১১ দফা, অধ্যায়-২ এ মক্কেলের প্রতি আচরণ ১-১৪ দফা, অধ্যায়-৩ এ আদালতের প্রতি কর্তব্য ১-৯ দফা ও অধ্যায়-৪ এ জনগণের প্রতি আচরণ ১-৮ দফায় বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আইনজীবী আইনগত ভাবে তত টুকু দায়ী থাকবেন যত টুকু আইন তাঁকে করেছেন |এর বাইরে কোনো আদালত তাঁকে বেশী দায়ী করতে পারবেন না |আইনজীবীরা অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবেন এটাই সবাই আশা করেন |
লেখকঃ চন্দন কান্তি নাথ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।