নুরন্নবী সবুজ
এই ম্যাক্সিমগুলোর সাথে সাথে আপনি প্রাসঙ্গিক আইন তার বিধানও জানতে পারবেন যা আপনার আইনের ভিত্তি আরো মজবুত ও সাবলীল করবে। তাই দ্বিধা না করে পুরোটি দেখুন ও মন্তব্য জানিয়ে উৎসাহিত করুন। ইংরেজিতে যেমন VOCABULARY, IDIOM & PHARSE এবং PREPOSITION জানা খুবই দরকার তেমনি আইনেও ম্যাক্সিম জানলে আইনের মূলনীতি সহ নানা বিষয় বুঝতে সহজ ও সুবিধা হয়। তাই আইন সংশ্লিষ্ট সকলের ম্যাক্সিম জানার সুবিধার্থে আজকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্সিম সহজ বর্ণনা করা হবে। আপনাদের চাহিদা থাকলে আরো দেয়া হবে।
nemo debet besse judex in propria causa: ন্যায় বিচার যেন নিশ্চিত হয় তার জন্য কতগুলো শর্ত পূরণ করা জরুরী। মামলার পক্ষপাত দুষ্টতা থাকলে তার দ্বারা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব না। দেওয়ানী কার্যবিধির ২৪ ধারা অনুযায়ী কোন পক্ষের যদি মনে হয় যে বিচারক পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে পড়েছেন বা কোন পক্ষের প্রতি বিশেষ ছাড় দিচ্ছেন বা কোন পক্ষ তাকে প্রভাবিত করছে তাহলে মামলা স্থানান্তরের আবেদন করা যায়। ফেীজদারী কার্যবিধির ৫২৬-৫২৮ ধারাতেও একই কথা বলা হয়েছে কোন পক্ষের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ থাকলে বা প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হলে মামলা স্থানান্তরের আবেদন করা যাবে । বিচারক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেন মামলার ন্যায়বিচার ব্যহত না হয় তার জন্য এই বিধান করা হয়েছে। এই ম্যাক্সিমটির অর্থও কোন বিচারকের নিজ মামলায় বিচারক হওয়া যাবে না।
nemo debet bis punti pro uno delicit: সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন ব্যাক্তিকে এক অপরাধের জন্য একাধিক বার ফেীজদারীতে সোর্পদ ও দন্ডিত করা যাবে না। একটি অপরাধের জন্য একজন ব্যক্তি একবারই বিচারের আওতায় আসবে ও শাস্তি পাবে। ফেীজদারী কার্যবিধির ৪০৩ ধারায়তেও দেখেছি কোন ব্যাক্তিকে এক অপরাধের জন্য দুইবার শাস্থি দেয়া যায় না। একজন ব্যক্তি একটি অপরাধের জন্য শুধুমাত্র একবারই শাস্থি পাবেন। এই ম্যক্সিমটির অর্থ একটি অপরাধের জন্য কাউকে দুইবার দন্ডিত করা যাবে না।
nemp est supra leges:একটি রাষ্ট্রে নানা ধর্ম বর্ণ ও জাতের লোক বাস করে। সবার জন্য যদি আলাদা আইন হয় তাহলে তাতে বৈষম্য তৈরী হবে যা সুখকর নয়। এজন্য আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। যদিও সবার জন্য আইন সমান এটি একটি নিরপেক্ষ ধারণা নয়। যেমন একটি এ্যাম্বুলেন্সের জন্য সব সময় রাস্তা ফাকা রাখার বিধান ,সরল বিশ্বাসে কোন ডাক্তার অপারেশন করলে যদি রোগী মারা যায় তা অপরাধ নাও হতে পারে। এগুলো ব্যতিক্রম হলেও আমাদের কামনা আইন ও আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হোক। সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে সকল নাগরিক তার যদি অধিকার লঙ্ঘিত হয় তাহলে প্রতিকার পাবে আদালতে আসার তার সুযোগ আছে , আইন তার সুরক্ষার জন্য যা যা দরকার করবে । আবার কেউ যদি অপরাধ করে তার শাস্তি অবশ্যই হবে। অল্প কথায়, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান ও সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এই ম্যাক্সিমে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটিই বলা হয়েছে আইনের উদ্ধে কেউ নয়। সহজ করে বললে আইনের মাধ্যমে সকলের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে।
nemineme oportet esse sapentorem leoribus: নানা গুণির নানা মত সবারই জানা। আইনের উপর যদি কথা বলার অধিকার দেয়া হয় তাহলে নানা রকমের মতবাদ ও প্রয়োগ তৈরী হবে। আর তাই আইনকেই সর্বদা সঠিক ও প্রয়োগযোগ্য ধরে কাজ করতে হয়। কেউ চাইলে আইনের উপর কথা বলতে পারে না। এই ম্যক্সিমের অর্থ হলো , আইন অপেক্ষা কারো বিজ্ঞ হওয়া উচিত নয়। অর্থ্যাৎ আইনে যা বলা আছে তাই তাকে মানতে হবে ও সঠিক ধরে কাজ করতে হবে।
nemo moriturus praesumitiur mentire: বাংলা সিনেমায় আমরা একটি কমন বিষয় দেখেছি মৃত্যুর আগে তার মৃত্যুর কারন বলে যাওয়া ও না যাওয়া নিয়ে একটি সিনেমার গল্প শেষ করতে। সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারাতেও বলা হয়েছে কোন ব্যাক্তি তার মৃত্যুর আগে যদি মৃত্যুর কারন নিয়ে কিছু বলে তাহলে তার সত্য বলে ধরে নেয়া হবে বা আদালত এটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করবেন। কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর আগে তার মৃত্যুর কারন সমন্ধে সত্য ও সঠিক কথা বলবেন এমন বিশ্বাস আদালত সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী করে থাকে। এই ম্যাক্সিমেও বলা হয়েছে যে ব্যাক্তি মৃত্যুমুখ পতিত হয়েছেন তিনি কোন মিথ্যা কথা বলবেন না বলে ধরে নেয়া হবে। মুমূর্ষু ব্যাক্তি সত্য কথা বলে এটি ম্যাক্সিম স্বিকৃত।
nemo tenteur seipsum accusare: সংবিধানের ৩৫(৪) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছ কোন অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। কোন ব্যাক্তি যদি অপরাধ করেও থাকে তাহলে তাকে অত্যাচার করে বা ভয়ভীতির মাধ্যমে কোন ভাবেই তাকে স্বিকার করতে বাধ্য করা যাবে না সে অপরাধ করেছে। সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারাতেও বলা হয়েছে কোন ব্যাক্তিকে তার নিজের বিরুদ্ধে দোষ স্বিকার করতে বাধ্য করা হলে তা অপ্রাসিঙ্গিক হবে। আইন অপরাধ প্রমাণ হবার পূর্ব পর্যান্ত কোন ব্যাক্তির নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে চায় বলেই এমন বিধান করা হয়েছে। এই ম্যাক্সিমেও এমন কথা বলা হয়েছে , কোন ব্যাক্তিকে তার অপরাধ স্বিকার করতে বাধ্য করা যাবে না।
damnum sine injuria: আপনার আইনগত অধিকার লঙ্ঘন হলেই কেবল আপনি আইনগত প্রতিকার পাবেন। আইনগত অধিকার লঙঘন না হয়ে যত বড়ই আর্থিক ক্ষতি হোক না কেন তার প্রতিকার আইন আপনাকে দিবে না। কোন ব্যাক্তির একটি দোকান আছে আর সে দোকান জনপ্রিয় হওয়ায় তাতে লাভ ভালো হয়। আরেক ব্যাক্তি সে দোকানের পাশে আর একটি দোকান দিলো। এতে করে পূর্বের দোকনের বিক্রি কমে যাওয়ায় আর্থিক লোকসান হওয়া শুরু করলো। যেহেতু এতে ১ম ব্যক্তির কোন আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি তাই যতই আর্থিক ক্ষতি হোক তার প্রতিকার আইন দিবে না। এই ম্যাক্সিমে এই কথাটিই বলা হয়েছে কোন ব্যাক্তির কোন কাজ বা কাজ বিরতি যতই আর্থিক ক্ষতি করুক তার যদি আইনগত লঙ্ঘন না হয় তাহলে তার আইনগত প্রতিকার নেই।
factum valet: ছোট বেলায় ছোট বড় ভুল সবাই কম বেশী করে থাকি। এই কাজগুলো সমর্থনযোগ্য না হলেও পিতা মাতা বিশেষ বিবেচনায় তা মাফ করে দেয়। যেমন বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি, বাজারের টাকা মেরে দেয়া, অহেতুক যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। ধর্মে কিছু বিধান আছে যার বাইরে আমরা যেতে পারি না আমাদের যাওয়া উচিত নয় । তারপরেও মাঝে বিধানের কিছু ক্ষেত্রে লঙ্ঘন হয়ে থাকে। এরুপ বিধান লঙঘন হলেও তার কিছু বিশেষ ব্যতিক্রমি বিধান রাখা হয়েছে। এই মতবাদটি মূলত হিন্দু দায়ভাগার অনুসারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যে কাজটি করা উচিত ছিলো কিন্তু করা হয় নি তা পরবর্তীতে আইন সিদ্ধ করে নেওয়া। দায়ভাগা নীতিতেও এর সামান্য প্রয়োগ হয়ে থাকে। বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতি নিয়ে বিবাহ করতে হয় কিন্তু অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই বিবাহ করা হলে তা পরবর্তীতে এই নীতি অনুযায়ী বৈধ করা হয়। বিবাহ ও দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে এই নীতির ব্যবহার সর্বাধিক। অবশ্যই পালনীয় কাজগুলোর ক্ষেত্রে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে।
lexest dictamen rationis: ১২১৫ সালে ম্যাগনাকর্টা বা অন্য কোন উত্তম আইন সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্টার জন্য। মানুষের বিবেক আর বুদ্ধি যা বলে তার থেকে প্রসুত। সমাজের সমাজিক জীবন যেন আরো সহজ সাবলীল ও সুন্দর হয় তার জন্যই আইন ও আইনের বিধান। এই ম্যাক্সিমে এই কথাটিই বলা হয়েছে আইন মানুষের স্বাভাবিক বিবেক, বুদ্ধি ও বিচার শক্তির সৃষ্টি।
lex fori: আমরা প্রত্যেক আদালতের স্থানীয় এখতিয়ার সমন্ধে জানি। কোথায় অপরাধ সংঘটিত হলে কোথায় মামলা দায়ের করতে হবে তা আইনেই বলা আছে। দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫- ২৩ নং ধারায় এখতিয়ার সমন্ধে বিভিন্ন কথা বলা আছে। আবার এই আইনেই আরো নানা বিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।মামলার এখতিয়ারের ক্ষেত্রে দেওয়ানী বা ফেীজদারী দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। আবার কিছু কিছু বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ আইন প্রচলিত থাকতে পারে।
যেমন পার্বত্য এলাকার জন্য আলাদা আলাদা কিছু আইন আছে। সেনাবাহীনি বা নেীবাহীনির জন্যও আলাদা আলাদা আইন আছে যার মাধ্যমে তাদের বিচার কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। পৃথিবীর সব দেশে একই রকম আইন নেই । যে স্থানের জন্য যে আইন তা সেখানেই প্রয়োগ করা হবে। এই ম্যাক্সিমে বলা হয়েছে , যে স্থানে মোকদ্দমা দায়ের করা হয়েছে সে স্থানের আইন। স্থানীয় আইন বিচারের ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রভাব ফেলে এটিই বুঝানো হয়েছে।
লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট। mdnurunnobiislam379@gmail.com