মুনতাসির মুজাহিদ
“রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ”এমন নীতি বাক্য লেখা রয়েছে দেশের প্রতিটি কারাগারের প্রধান ফটকে। কিন্তু কারা অভ্যন্তরে বন্দীরা কতটুকু নিরাপদ, কতটুকু দেখে আলোর পথ কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারে।কারাগারে দু’ধরণের বন্দীদের বসবাস। হাজতী এবং কয়েদী। যাদের মোকদ্দমার রায়ে শাস্তি সাব্যস্ত হয়েছে এবং সে অনুযয়ী কারা ভোগ করছে তাদের বলা হয় কয়েদী। আর বিচারাধীন কারাবন্দীদের বলা হয় হাজতী।
কারাবন্দীদের মানবিক আচরণ পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। দেশের সংবিধানের ৩৩ নংঅনুচ্ছেদে আটক ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।এছাড়াও International covenant on civil and political rights এর ১০নং অনুচ্ছেদে আটক ব্যক্তির অধিকার স্বীকৃতহয়েছে।
এতে বলাহয়েছে, একজন ব্যক্তিকে আটকহওয়ারচব্বিশঘন্টারমধ্যে (যুক্তিসঙ্গত কারণেবিলম্ব ব্যতীত) আদালতেসমর্পণকরতেহবে।কারাগারে তার আবাসন, আহার, চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ইত্যাদির সুব্যবস্থা করতে হবে। অভিযুক্তদের অপরাধপ্রমাণের পূর্বে তাদেরকে নিরাপরাধ বলে ধরে নিতে হবে। হাজতী ও কয়েদীএবংকিশোর অপরাধী ও বয়স্কদের বা নারীদের পৃথক রাখতে হবে। সুতরাং এ সকল অধিকার আটক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার।
কিন্তু দেশের অধিকাংশ কারাগারে বন্দীদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। হামেশা লঙ্ঘন করা হচ্ছে তাদের এ সকল অধিকার।অধিকার আদায়ে আইনের দোহাই সেখানে অকার্যকর; বরং ঘুষ দিলে এখানে সবই কার্যকর।বাইরে চলে ক্যাশ টাকা আর ভিতরে চলে বিভিন্ন ধরণের‘ বিশেষমুদ্রা’। সিগারেট,স্পিডইত্যাদি হলো এখানকার বিনিময় মুদ্রা।
নতুনবন্দী গেলে প্রথমে তার স্থান হয় আমদানীতে। সেখান থেকে তার আবাসন নির্ধারণ হয়। একজন বন্দীর কোথায়এবং কোন মানের সিট বরাদ্দ হবে তা নির্ভর করে ম্যাট এবংরাইটারদের কি পরিমাণ ‘মুদ্রা’ দেয়া হয়েছে তার উপর। এর অংশ চলে যায় সুবেদার হতে জেলার পর্যন্ত। অসুস্থ ব্যক্তি ওয়ার্ডে কাতরালে ও টাকার জোরে মাসের পর মাস হাসপাতালের সিটে থাকে সুস্থ-সবল রাঘব বোয়ালরা।
কারাগারের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী প্রতি ১৫ দিনেএকদিন স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পাবে হাজতীরা। সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে ‘সাক্ষাৎঘর’। এ যেন আরেক নির্মমতা! সাক্ষাতের সময় ২০ থেকে ৩০ মিনিট। স্বজনদের খুঁজে পেতে পেতেই পার হয়ে যায় অর্ধেক সময়। কখনো কখনো ভিড়ের মধ্যে অনেকের দেখাই মেলেনা।
দেখা হলেও কথা বলতে হয় অন্তত পাঁচ ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে। মাঝেচার-পাঁচ স্তরের লোহার শিক। চিৎকার দিয়ে প্রিয়জনকে প্রয়োজনীয় কথা বা প্রাণের কথা শোনাতে মরিয়া সবাই। কিন্তু শত-সহ¯্র স্বরের মাঝে জমানো কথাগুলো অব্যক্তই রয়েযায়।
বিকল্পব্যবস্থাও রয়েছে কারা কতৃপক্ষের কাছে। অফিস কল। বন্দীর সাথে একান্তে আলাপের বিশেষ ব্যবস্থা। এ বিশেষব্যবস্থার জন্য গুণতে হয়বিশেষ‘হাদীয়া’। একশ’টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়ে থাকে। এই টাকা ভাগে ভাগে চলে যায় সংশ্লিষ্ট সবার পকেটে।
কারাগারবন্দীদের স্বাভাবিক জীবনেফিরিয়ে আনারকথা। অপরাধপ্রবণ মানসিকতা পরিহার করানো ও কর্মদক্ষতা তৈরী করার কথা। এজন্য নৈতিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের তেমন কোনব্যবস্থা নেই। ফলে বন্দীরা আলোর পথের দেখা আর পায়না। বরং যে ছোট অপরাধের দায়ে জেলে যায় অধিকাংশ সময় দেখা যায় সে আরো বড় অপরাধ করার হিম্মত নিয়ে বেরহয়।
দেশের ১৩ টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫ টি জেলা কারাগার মিলে বন্দীআছেপ্রায় ৮০ হাজার। এদেরমধ্যে ৮১ শতাংশ বিচারাধীন।যাদের বিরুদ্ধে এখনো সুস্পষ্ট কোন অপরাধপ্ রমাণ হয়নি। তার মধ্যে রাজনৈতিক মামলা, গায়েবী মামলা কিংবা মিথ্যা মামলায় বিপন্ন হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। কারাগারের ভিতরে-বাইরে, নামে-বেনামে ঘুষ দিতে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে এ সকল পরিবার।
অভিযুক্ত কিংবা অপরাধী প্রত্যেকেই মানুষ। তাদের ও মানবাধিকার রয়েছে। রয়েছে আইনের সমান সুযোগ লাভের অধিকার। সে অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে প্রতিটি কারারুদ্ধ নিরুপায় মানুষকে। মানবাধিকার লাভের জন্য যাতে আরো কোন আটক ব্যক্তিকে ঘুষ গুণতে নাহয় তার কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ঘুষ গ্রহণের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য চক্রগুলো আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কারবন্দীরা অতিরিক্ত না হোক; নির্ধারিত অধিকারটুকু যেন পায় নির্বিঘেœ। কারাগার যেন পরিণত হয় অপরাধীদের শোধনাগারে।
লেখক: মুনতাসির মুজাহিদ, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।