করোনা মহামারীর কারণে প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর ৩০ মার্চ দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। একই দিন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু ঈদের পর ২৪ মে থেকে শুরু হবে বলেও জানানো হয়। দেশে সংক্রমণ কমে আসায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। সেদিন করোনার শনাক্ত হার ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। পরের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি শনাক্ত হার আরও কমে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ হয়। এর আগে ফেব্রুয়ারিজুড়ে প্রতিদিন গড়ে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হয়। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তের তৃতীয় দিন অর্থাৎ চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে হঠাৎ করেই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। ওইদিন রোগী শনাক্ত হার এক লাফে ৪ শতাংশের ওপরে উঠে যায়। সেদিন ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হয়, যা ছিল তার আগের ৪১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া একই দিন প্রায় এক মাস পর শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যাও ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এমনকি গত কয়েক দিন ধরে সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে। শনাক্ত হার আবার ৫ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে এবং রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ৩০ মার্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন করে ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। সংক্রমণ পরিস্থিতি এমন থাকলে আদৌ স্কুল-কলেজ খুলবে কি না সে নিয়ে সংশয়ে আছেন করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।
সংক্রমণ এমন থাকলে বা আরও বাড়লে এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নন বিশেষজ্ঞরা। আর খুললেও যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সীমিত আকারে খোলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে স্কুল-কলেজ খোলা দরকার, যাতে স্কুল-কলেজ খুলে সংক্রমণ বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি না করি। সরকার যদি যথেষ্ট আস্থাবান হয় যে একেবারে প্রস্তুতি ঠিকমতো নেওয়া হয়েছে, তাহলে স্কুল-কলেজ খোলা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১৫-১৬ মার্চ পর্যন্ত দেখব। তখন সংক্রমণ পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটার ওপর বিবেচনা করে একটা ঘোষণা দেব। তবে এখন পর্যন্ত আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে।
একইভাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত আগের ঘোষণা বহাল রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্কুল-কলেজ খোলার ব্যাপারে ১৩ মার্চ বিকেলে তথ্য মন্ত্রণালয় একটি বৈঠক ডেকেছে। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা থাকবেন। সেই সভার সিদ্ধান্ত ছাড়া বলতে পারব না স্কুল-কলেজ খুলবে কি না। সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী করবে, সেখানে সিদ্ধান্ত হবে। তবে এখন পর্যন্ত যেটুকু দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আরও দুই সপ্তাহ দেখতে হতে পারে। তখন সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝা যাবে। তবে সত্যি যদি এরকম বাড়তে থাকে, তাহলে তো আশঙ্কার কথা।
স্কুল-কলেজ খোলার আগে সরকার শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত ৪০ বছরের কমবয়সী শিক্ষকদের টিকাদান শুরু হয়নি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, শিক্ষকদের তালিকা পেয়েছি। তবে সবার পাইনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা মোটামুটি পেয়ে গেছি। তাদের মধ্যে যাদের বয়স ৪০ বছরের নিচে আছে, তাদের নিবন্ধন করার জন্য ঘোষণা দেওয়া হবে শিগগির। এখন সুরক্ষা অ্যাপে যে শিক্ষক ক্যাটাগরি আছে, সেখানেই তারা নিবন্ধন করতে পারবেন। ৪০ বছরের ওপরে যাদের বয়স, তারা তো আগে থেকেই নিতে পারছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তালিকা এখনো পাইনি। তবে স্কুল-কলেজ খোলার আগে সব শিক্ষককে টিকা দেওয়া সম্ভব বলে জানান মহাপরিচালক। তিনি বলেন, আমরা দৈনিক দুই লাখের বেশি টিকা দিতে পারি। ১০ লাখ শিক্ষককে দিতে সর্বোচ্চ ১০ দিন লাগবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, সংক্রমণ বাড়ছে। কেউ কিছু মানছে না। এখন আইন প্রয়োগ করেই স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। এমনিতেই মানবে না। নতুন ভেরিয়েন্ট সংক্রমণ করে। তবে সেটার বিস্তারিত স্টাডি করা নেই। আমাদের কাছে বেশকিছু প্রমাণ আছে। তবে সংখ্যাটা বেশি না। এটার ধরনটা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরকে বলা হয়েছে। এটার জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা বা ব্যবস্থা নেই। মানুষ যেন স্বাস্থ্যবিধি মানে। এটা সবাইকে আবার বলতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তখন তো সংক্রমণের হার ২ শতাংশের মাঝামাঝি ছিল। এখন তো আবার বাড়ছে। ফলে খুলতে হলে সবকিছুর একটা সমন্বয় আনতে হবে। এখন খুলতে হলে সবাইকে নিয়ে মিটিং করতে হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তথ্য ও মত তুলে ধরবে। তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এখনো ৩১ মার্চ আসতে তিন সপ্তাহের মতো সময় আছে। সংক্রমণ কোন পর্যায়ে যায় সেটাও বোঝা যাবে।
এ বিশেষজ্ঞের মতে, সংক্রমণ হার ৫ শতাংশের নিচে টানা কয়েক মাস থাকলে স্কুল-কলেজ খোলার কথা বলা হয়। সেটা বাংলাদেশে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে আবার বেড়ে গেছে। পাশাপাশি শিক্ষক ও ১৮ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকাও নিশ্চিত করতে হবে। সবকিছু মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেহেতু জীবনের অন্য কোনো ক্ষেত্রে কোনো বাধানিষেধ নেই, তাই স্কুল-কলেজ না খোলার কোনো যুক্তি নেই। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ই জীবনের সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। সে ক্ষেত্রে তারা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকে এবং সেখান যদি সংক্রমণ প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারি, তাহলে সমস্যা নেই। তবে খুব ভালো হতো যদি সব শিক্ষক ও ১৮ বছরের ওপরের শিক্ষার্থীদের প্রথমেই টিকা দিয়ে দিতে পারতাম। এ দুই শ্রেণিকে যদি প্রথম ডোজ আগেই দিয়ে ফেলতাম এবং দ্বিতীয় ডোজ যদি এই মাসে দিতে পারতাম, তাহলে একটি প্রটেকশন আসত। তাহলে এসব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ হতো না। আর কিছুসংখ্যক সংক্রমিত হলেও হাসপাতালে ভর্তির মতো অবস্থা হতো না। সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেত।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি হাত ধোয়ার ব্যাপার করতে পারতাম তাহলেও হতো। সেই ওয়াশ ব্লক আমাদের এখানে নেই। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে গাইড লাইন দিতে হবে। ট্রেনিং দিতে হবে। মনিটরিং করতে হবে। আমরা এক বছর সময় পেলাম। এতদিনে অনেক ব্যবস্থা নিতে পারতাম। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে সংক্রমণ প্রতিরোধ টিম করতে পারতাম। স্বাস্থ্যবিধির সব নিয়ম যদি মানতাম, তাহলে এখন খোলা অনেক সহজ ছিল।
প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়, তবে সংক্রমণ আবার বাড়িয়ে দেবে কি না সেই চিন্তাটা থাকছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা উচিত। এখন নতুন ভেরিয়েন্টটা কোথায় কতটুক ছড়িয়েছে, জেনোম সিকোয়েন্স করা উচিত। তিন মাস আগে পাওয়া গেল। তখনই যদি এই নানাদিক সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া হতো, তখন থেকেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। কারণ করোনার নতুন ভেরিয়েন্টটা যদি খুব ছড়ায়, তাহলে আরও বিপদ। কারণ এ ভেরিয়েন্ট শিশুদের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এমন একটা মিউটেশন হয়েছে, যেটা শিশুদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ খোলার পক্ষে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্কুল-কলেজ খোলার পরিবেশ তো অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। এখন অবশ্যই স্কুল-কলেজ খুলতে হবে তবে স্বাস্থ্যবিধি মানা, একটা ক্লাসরুমে যেন অনেক ছাত্রছাত্রী না থাকে, ভেন্টিলেটর থাকে, বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে, অর্থাৎ সংক্রমণ প্রতিরোধে সব স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ রাখতে হবে নিরাপদ। সংক্রমণ যেন সেখানে না ছড়ায়। সংক্রমণ বাড়লে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শুধু স্কুল-কলেজে নয়, সবখানেই আছে।
শিক্ষকদের টিকাদান প্রসঙ্গে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, টিকা যত বেশি দেওয়া যায়, ততই ভালো। টিকা নেওয়ার পর সংক্রমিত হলেও মারাত্মক রোগ হবে না। জীবনের নিরাপত্তা বাড়বে। তবে টিকা নেওয়ার আগে বা পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।