অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
দলিল পত্রের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত নিয়মাবলী আলোচনার আগে প্রথমেই দেখা যাক দলিল বা Document শব্দটি দ্বারা কি বোঝায়। দলিল বলতে অতি সাধারন অর্থে এমন একটি লিখিত বিবরণকে বুঝায় যার মাধ্যমে উহার দাতা ও গ্রহিতা একটি মতৈক্যে পৌঁছে এবং উহার মাধ্যমে পক্ষদের মধ্যে একটি আইনগত বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি হয়। American Button-Hole Over seaming S.M Co. Vs Burluck মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্ট দলিলের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, A deed is a writing or instrument written on paper or parchment, sealed and delivered to prove and testify the agreement of the parties whose deed it is to the things contained in the deed “ একই আদালত অন্য একটি মামলায় উক্ত বিষয়ে বর্ণনা করেন, Deed is a written instrument under seal containing a contract or agreement which has been delivered by the party to be bound and accepted by the oblige or convenantee“
দলিলের বৈশিষ্ট্য হল ইহা লিখিত এবং যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা স্বাক্ষরিত হতে হবে। দলিল ব্যাখ্যার সময় প্রথমে দেখতে হয় উহা কোন ধরনের দলিল। অর্থাৎ উহা কবলা দলিল,বন্ধকী দলিল,বায়নাপত্র দলিল,দানপত্র দলিল,নাদাবী দলিল বা অন্য কোন প্রকৃতির দলিল কিনা । এটা দেখার পর দলিলের প্রকৃতি অনুযায়ী লক্ষ্য করতে হয় উহাতে দাতা,গ্রহীতা ও স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য,সম্পত্তির পরিচয় ইত্যাদি সঠিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে কিনা। তারপর সঠিক পরিমাণে রেজিষ্ট্রেশন ফিস প্রদানপূর্বক উহা রেজিস্ট্রি করা হয়েছে কিনা তাহাও খুব গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করতে হয়।
এরপর দলিলে ব্যবহৃত শব্দাবলীর অর্থ উদঘাটন করে দলিল দাতার সম্পত্তি হস্তান্তর বিষয়ে কি উদ্দেশ্য ছিল তা বের করার প্রয়োজন পড়ে। দলিলে ব্যবহৃত শব্দাবলীর অর্থ দ্যার্থবোধক হলে আইন ব্যাখ্যার প্রচলিত নীতিমালার আলোকে উহাদের ব্যাখ্যা করতে হয়। এ জন্য বিশেষ কোন নীতিমালা নেই। সাধারন বিবেকবান একজন মানুষ দলিলটি যেভাবে কার্যকর করার কথা ভাবেন ঠিক তেমনি ঐ দলিলটি যাতে কার্যকর করা যায় সে দিকে লক্ষ রেখেই উহার ব্যাখ্যা করা আবশ্যক। Langston Vs Langston মামলায় দলিল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আদালতের কেমন দৃষ্টিভঙ্গি নেয়া উচিৎ সে প্রসঙ্গে বিচারপতি Brougham বলেনঃ There are two modes of reading an instrument where the one destroys and the other preserves, it is the rule of law, and of equity, following the law in this respect(for it is a rule of commonsense…) that you should rather lean towards that construction which preserves, than towards which destroys. “
পুর্বোক্ত মামলার সিদ্ধান্তের মত Mozaffar Ahmed Vs Md Osman & other মামলায় দলিল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উহার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের পক্ষে রায় প্রদান কালে প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন উল্লেখ করেন, It is … An established rule of interpretation not to interpret word or expression to defeat the purpose of dedication, rather the interpretation will be to uphold the dedication as far as possible, “
দলিল ব্যাখ্যার সময় উহাতে বর্ণিত সমস্ত শর্তাবলী একত্রে বিবেচনা করে দলিলের উদ্দেশ্য বের করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত Lowdermilk Brothers Vs Bostick মামলায় ঐ আদালত এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন,- All the terms of a deed should be construed together… And the words therein should be taken most strongly against the party using them“
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি দলিল সম্পাদন যথার্থভাবেই হয়েছে কিন্তু রেজিস্ট্রি হয় নাই,অনুরুপ ক্ষেত্রে ঐ দলিলের ধারক উহার স্বত্ব দাবি করতে পারবে কি না সে বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এ প্রসঙ্গে Amirunnessa Vs Abdul Mannan মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন মন্তব্য করেন,The plaintiffs basic title deed is an unregistered deed of gift. But since the plaintiffs have been successful in proving that they exclusively possessed the suit property for over 12 years on the basis of this imperfect document and kept the defendants out of possession for the said period, the plaintiffs have acquired a valid title by adverse possession even on the basis of the defective deed of gift“
দলিলের ধরন,বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে দলিলে বর্ণিত পক্ষদের ইচ্ছা উদ্ধার করতে হয়। Somedullah Vs mahmud ali মামলায় একটি দলিল বন্ধকি দলিল না পুনঃক্রয়ের দলিল উহা নির্ধারনের পদ্ধতি আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোস্তফা কামাল দলিল ব্যাখ্যার বিস্তারিত পদ্ধতি আলোচনা করেন। তাঁর মতে– It is the settled law that the document in question itself read as whole will primarily determine whether the document is a mortgage or an out and out sale with a condition of repurchase.Th intention of the parties is to be gathered from the character of the document itself as well as from the surrounding circumstances. “
কোন দলিলে যদি কখনও কোন শর্ত উল্লেখ থাকে তাহলে ঐ শর্ত সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাবে মর্মে Tobarak ali Vs Administrator of Waqfs মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ মত প্রকাশ করেন। দলিলে বর্ণিত অনুরুপ বিধান কিভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে তা আলোচনা করতে গিয়ে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি কে.এম. হাসান বর্ণনা করে-It has always been considered a cardinal principle of interpretation of any deed or statute that a proviso to a section will have an overriding effect over the whole provision.
সুতরাং দেখা যায় দলিল পত্রের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে পক্ষগণ একটি মতৈক্যে পৌঁছে। ফলে দলিল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে positive দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উহাদের ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
কবলা দলিল ও উহার ব্যাখ্যাঃ
আক্ষরিক অর্থে কবলা বলতে সম্পত্তি হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে পক্ষগনের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বোঝায়। ব্যবহারিক অর্থে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের মাধ্যমে হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে পক্ষগন কর্তৃক সম্পাদিত দলিলই কবলা দলিল নামে পরিচিত। অন্যান্য চুক্তির মতই কবলা দলিল সম্পাদনের সময় পক্ষগনের স্বাধীন সম্পত্তি ও প্রতিদান থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। কেবলমাত্র বিক্রেতা কর্তৃক বিক্রয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর গ্রহীতা যদি ঐ প্রস্তাব গ্রহন করে এবং তৎপর গ্রহিতা হস্তান্তরকারীকে সম্পত্তির মুল্য পরিশোধ করে তাহলেই কবলা দলিল সম্পাদন করা যায়। এই দলিল সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ২০০৪ সনের সংশোধনী অনুযায়ী মূল্য নির্বিশেষে রেজিস্ট্রি করতে হয়।কবলা দলিলের দ্বারা সম্পত্তির স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়। একটি কবলা দলিল প্রকৃত অর্থে কার্যকরী হয়েছে কি না তা ব্যাখ্যা করতে হলে নিম্ন বর্ণিত তিনটি বিষয় বিচেনা করতে হবে।
(ক) বিক্রয়ের চুক্তিঃ এটি কবলার প্রাথমিক পদক্ষেপ। পক্ষগণ কবলা সম্পাদনের আগে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রয় চুক্তি বা বায়নাপত্র সম্পাদন করতে পারে। তবে বায়নাপত্র না করেও কবলা দলিল সম্পাদন করা যায়।
(খ) মূল্য পরিশোধঃ মূল্য পরিশোধ দলিল সম্পাদনের একটি অপরিহার্য উপাদান। প্রতিদান বিহীন চুক্তি আইনের দৃষ্টিতে কোন চুক্তি নয়। তাই মূল্য পরিশোধ করা না হলে কবলা হতে পারে না। তবে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৪ ধারার বিধান অনুসারে মূল্য পরিশোধের অঙ্গীকার থাকলেও কবলা হতে পারে।
(গ) দখল অর্পণঃ মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরের জন্য দখল অর্পনের কোন বিকল্প নাই।
তাই উপরে বর্ণিত উপাদানগুলো বিবেচনায় রেখে চুক্তি ব্যাখ্যার প্রচলিত অন্যান্য বিধি বিধানের আলোকে কবলা দলিল ব্যাখ্যা করতে হয়। একটি দলিল উহা কবলা দলিলই হোক বা অন্য কোন দলিলই হোক উহাকে ব্যাখ্যা করার সময় দলিলে বর্ণিত পক্ষদের ইচ্ছা উদঘাটন করতে হয়। সর্বোপরি বাংলাদেশ সংবিধান আমাদের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে বর্ণিত শব্দাবলীর spirit আমাদের আইন প্রনয়ন ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরনার উৎস।আমরা জানি ইকুইটি আইনের অন্যতম একটি নীতি হল ইহা দলিলের বাহ্যিক আকৃতির চেয়ে উহার উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেয়। তাই আদালত ঐ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
কলামিস্ট ও আইনজীবী, জজকোর্ট মেহেরপুর
ইমেইল: mizanmpur06@gmail.comমোবাইলঃ ০১৭১৯-৪৭৭ ৫৫২