সব
facebook apsnews24.com
আইনজীবী,আইন ব্যবসা ও আইনের শাসন এবং একটি আত্ম বিশ্লেষন - APSNews24.Com

আইনজীবী,আইন ব্যবসা ও আইনের শাসন এবং একটি আত্ম বিশ্লেষন

আইনজীবী,আইন ব্যবসা ও আইনের শাসন এবং একটি আত্ম বিশ্লেষন

অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান

পৃথিবী জুড়ে আজ মানবাধিকার ও আইনের শাসনের কথা বলা হচ্ছে।আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন,মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য,স্বাধীনতা ও সুবিচার সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার রয়েছে।আমরা আনজীবীরা আইনের শাসন সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে সোচ্চার হলেও প্রশ্ন থেকে যায় কার্যতঃ  আইনের শাসন বলবৎ করার ব্যাপারে আমরা কতটুকু সহায়ক ভূমিকা পালন করছি।

আইনের শাসন বলতে আমরা যা বুঝি এবং এ সম্পর্কে আমাদের ধ্যান ধারনা প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে। তবে একথা অনস্বীকার্য আইনের শাসন-এর দুটি দিক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এক. আইনের চোখে সকলেই সমান এবং আপামর জনসাধারন সকলের উপর আইন সমভাবে প্রযোজ্য।দুই.আইনের গুনগত মান যা মানবাধিকার ও রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচারকে নিশ্চিত করবে।আইনের গুনগত মান সম্পর্কে আমরা মন্তব্য রাখতে পারি বিভিন্ন সমাবেশে আলোচনা করতে পারি,আদালত এর সমালোচনা করতে পারি এবং এইভাবে আইনের গুনগত মান সম্পর্কে জনমত গড়ে তুলতে পারি।কিন্তু আইন প্রনয়ন বা আইনের সংশোধন ও উৎকর্ষ সাধন করতে পারেন জনপ্রতিনিধি সংসদ সদস্যরা। এব্যাপারে আইনজীবীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। আইনের শাসন এর অপর দিক অর্থাৎ বৈষম্যহীন আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে আইনজীবীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে।এ প্রত্যক্ষ ভূমিকা যদি আমরা সঠিকভাবে পালন না করি তবে আইনের গুনগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের বক্তৃতা ও সমালোচনা লোক দেখানো প্রচেষ্টায় পর্যবেসিত হবে।তাছাড়া আইন প্রয়োগে সমতা না থাকলে আইন যতই গুনগতমান সম্পন্ন হোক না কেন তা শুধুমাত্র অলংকার হয়ে থাকবে।

আদালতে দ্রুত ও সহজে অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা না থাকলে আইনকে অগ্রাহ্য করা প্রবনতা কখনো রোধ করা যাবে না। আমাদের দেশে বেশীরভাগ লোক অশিক্ষিত ও দরিদ্র। এদের পক্ষে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদালতের আশ্রয় নেয়া সম্ভব হচ্ছে না যার ফলে এরা বেআইনী কার্যকলাপের শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশে লিগ্যাল এইডের মত প্রতিষ্ঠান থাকলেও পক্ষদের অনিহার কারনে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া ক্রমাগতই আইন ব্যবসা বাজার অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছে। আইনজীবীরা আইন ব্যবসাকে অন্যান্য ব্যবসার মত মনে করছেন এবং এই ব্যবসায়ে যে সমাজ সেবার একটা দিক রয়েছে সেটা ভুলতে বসেছেন।জেষ্ঠ্য আইনজীবীগণ তাদের পারিশ্রমিককে এত বিরাট অঙ্কে নির্ধারন করছেন যে,দারিদ্য জনগণ দুরে থাক সাধারন অবস্থার লোকদের পক্ষে সেই জেষ্ঠ্য আইনজীবীগনকে নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।তাদের নির্ধারিত পারিশ্রমিক বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অর্থশালী এবং বিশেষ করে দুর্নীতি পরায়ণ লোকদের পক্ষেই দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বিচারকগণ সঙ্গতভাবেই জেষ্ঠ্য আইনজীবীগণকে সমীহ করেন এবং জেষ্ঠ্য আইনজীবীগণ তাদের মেধা ও অভিজ্ঞতার কারনে প্রতিকার প্রদানে অনেক বেশী সফল হন যার সুফল বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অর্থবান এবং অসাধু লোকজনই পাচ্ছে।এটা ঠিক যে জেষ্ঠ্য আইনজীবীগণ মাঝে মধ্যে দু একটা মোকদ্দমা কোন ফিস না নিয়েই করে থাকেন। কিন্তু এর সংখ্যা অত্যন্ত কম এবং এতে করে সাধারন লোকের আদালতের আশ্রয় নেবার সুযোগ বৃদ্ধি হচ্ছে না।জেষ্ঠ্য আইনজীবীগনকে অনুসরন করে মধ্যম সারির আইনজীবীগণও উচ্চহারে পারিশ্রমিক দাবি করছেন ও আদায় করছেন যা সাধারন মানুষের পক্ষে দেয়া অসম্ভব।নিম্ন সারিতে যেসব আইনজীবী আছেন তাদের আইন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কম,কার্যক্ষমতাও স্বল্প,ফলে প্রতিকার প্রদানের অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা সফল হন না।সামগ্রিক পরিস্থিতি হচ্ছে সাধারন লোকের পক্ষে আদালতের আশ্রয় নিয়ে সুবিচার পাওয়া একটা কঠিন ব্যাপার।সার্বিক অবস্থা হচ্ছে সুবিচার ক্রয়-বিক্রয়ের সামগ্রী হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে সাধারন মানুষ অচ্ছুৎ আইনের গুনগত মান যতই উন্নত করুক না কেন আইনজীবীগণ যদি তাদের পেশায় সমাজ সেবার দিকটা মনে না রাখেন দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত হবে না।কারন দেশের অধিকাংশ লোকই প্রকৃত অর্থে আদালতেই আশ্রয় থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে,মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হতে অত্যন্ত বিলম্ব হচ্ছে এবং এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে প্রধানতঃ দরিদ্র ও সাধারন বিচার প্রার্থীদের উপর।বিলম্বিত প্রক্রিয়ায় মোকদ্দমা নিষ্পত্তির ফলে বহু ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও সাধারন বিচার প্রার্থীগণ মধ্য পথেই আদালত প্রাঙ্গন ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন কারন দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালানোর ক্ষমতা তাদের নেই। যদি কোন অবস্থাপন্ন লোক ইচ্ছা করে তবে সে মামলা দীর্ঘায়িত করে শুধুমাত্র অর্থের জোরে বিচার তার স্বপক্ষে নিয়ে যেতে পারে এবং আমরা আইনজীবীরা মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এদেরকে সাহায্য করে চলেছি।দেওয়ানি কার্যবিধির নিয়ম অনুযায়ী মোকদ্দমা শুরু হলে কোন বিশেষ কারন থাকলে adjourn করা যাবে না। আমরা আইনজীবীরা এ নিয়ম মানি না এবং বিচারকগণ এই নিয়মের কথা মনে রাখেন না। প্রায়ই দেখা যায় একটি মাত্র স্বাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে মোকদ্দমার শুনানি অন্য একটি তারিখ adjourn করা হচ্ছে।বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে তো দেশের পুরো বিচার ব্যবস্থা বন্ধ আছে। দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি না হবার কারনে আইন ভঙ্গের প্রবনতা বেড়ে যাচ্ছে।আর্থিক ও সামাজিক কারনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আইন ভঙ্গ করা অবস্থাসম্পন্ন লোকের পক্ষেই করা সম্ভব।ফলে বর্তমান অবস্থায় আইনের শাসন কথাটি অবস্থাসম্পন্ন লোকের ক্রয় সামগ্রী।আমি বহু সাধারন বিচার প্রার্থীকে বিলম্বের কারনে হতাশ হয়ে মোকদ্দমা শেষ হবার বহু আগেই আদালত প্রাঙ্গন ত্যাগ করতে অথবা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হতে দেখেছি।

আমরা আইনজীবীরা অনেক ক্ষেত্রেই কেসের merit না দেখেই মামলা দায়ের করছি। দেখা যাচ্ছে ভাল পারিশ্রমিক পেলে আইনজীবীগণ স্পস্টতঃই কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে না এমনও মোকদ্দমা দায়ের করছেন। কারন তাঁদের অর্থশালী মক্কেলরা তাঁদেরকে বলছেন মামলা দায়ের করে দিন,শুনানি করবেন না,এতেই অপরপক্ষ পেরেশান হয়ে যাবে।প্রকৃত পক্ষে এ ধরনের মোকদ্দমায় পরিশেষে কোন সুফল না পেলেও অপর পক্ষকে হয়রানী করার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে এবং অবস্থা বিশেষে অপর পক্ষ তার ন্যায্য অধিকার পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।তাছাড়া এধরনের merit বিহীন মোকদ্দমা দায়ের হওয়াতে মোকদ্দমার সংখ্যা অযথা বেড়ে যাচ্ছে। মোকদ্দমার ভীড়ে অগ্রাধিকার নিতে পারে শুধুমাত্র অবস্থাসম্পন্ন বিচার প্রার্থীরা।সাধারন অবস্থার বিচার প্রার্থীরা বিপাকে পড়ে মার খাচ্ছে।এ এক ধরনের অন্যায় এবং আইনজীবী হিসেবে এ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া আমাদের উচৎ নয়। কিন্তু আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি। বর্তমানে বিচারকগন প্রায়ই রায় বা আদেশ দেওয়ার সময় লিখছেন- There will be no order as to cost” এ ধরনের আদেশ merit বিহীন মোকদ্দমা দায়ের করাকে উৎসাহিত করছে।

দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি তাদের অধিকার বজায় রাখার জন্য আইনের আশ্রয় নিতে না পারে তাহলে আইনের শাসন কাদের জন্য? আমরা আইনজীবীরাও শুধুমাত্র আমাদের আর্থিক সুবিধার কথায় চিন্তা করছি এবং আমাদের পেশার সেবামূলক দিকটাকে অবহেলা করছি।এভাবে চলার জন্য আইনভঙ্গের প্রবনতা বেড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ সামাজিক কাঠামোটায় ভেঙ্গে পড়বে।

লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান

কলামিস্ট ও আইনজীবী, ইমেইল:mizanmpur06@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

হিন্দু বিবাহ রেজিষ্ট্রি না করার ফলাফল ও প্রাসঙ্গিকতা

হিন্দু বিবাহ রেজিষ্ট্রি না করার ফলাফল ও প্রাসঙ্গিকতা

আইনজীবী হলেন ৫ হাজার ৯৭২ জন

আইনজীবী হলেন ৫ হাজার ৯৭২ জন

আইনজীবী নিবন্ধনে পরীক্ষার তারিখ নির্দিষ্টকরণ ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ভার্চুয়াল সভা

আইনজীবী নিবন্ধনে পরীক্ষার তারিখ নির্দিষ্টকরণ ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ভার্চুয়াল সভা

জমি অধিগ্রহণ কি, কেন, কখন, কিভাবে?

জমি অধিগ্রহণ কি, কেন, কখন, কিভাবে?

বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট যে কোন দিন

বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট যে কোন দিন

প্রবীণ আইনজীবী এস এম মনজুর উল আলমের মৃত্যুতে জাতীয় মানবাধিকার সমিতির শোক

প্রবীণ আইনজীবী এস এম মনজুর উল আলমের মৃত্যুতে জাতীয় মানবাধিকার সমিতির শোক

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj