জিয়াউল,ফিরোজ, (স্টাফ রিপোর্টার): শত অনুনয়েও করোনার টেস্ট ছাড়া ভর্তি করছে না কোন হাসপাতাল, মুমূর্ষু রোগী নিয়ে অসহায় স্বজনরা ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে৷ এক পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন রোগী৷ তাদের মৃত্যুর কারণ কিন্তু করোনা ভাইরাস নয়৷ হাসপাতালে ভর্তি না করানো, ভর্তি করলেও ডাক্তারের অবহেলায় বেশীরভাগ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
গত ২৩শে জুন পেট ব্যাথা, বমি আর পাতলা পায়খানা বন্ধ হচ্ছিল না বিধায় সাংবাদিক মোহাম্মদ ফিরোজ এর মাকে নিয়ে গিয়েছিল ন্যাশনাল হসপিটালে। করোনা রোগী সন্দেহ করে ভর্তি করছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেক আকুতি মিনতি করে প্রায় তিন ঘণ্টা পর ভর্তি করে কিন্তু কোন ডাক্তার ভালো মতো দেখল না। নার্স এসে বলে অক্সিজেন লাগবে রোগীর অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করে নিয়ে আসেন আমাদের হাসপাতালে কোন অক্সিজেন নেই। শুধু মাত্র স্যালাইন দিয়ে ইমারজেন্সি বেডে ফেলে রাখে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন রোগী সঙ্গে থাকা সাংবাদিক ফিরোজ এর ভাতিজা ইমন ।
ইমন জানান, আমার দাদী হাজী ছুরা খাতুন (৭৫) আমরা চন্দ্রঘোনা কদমতলী ইউনিয়নের লিচু বাগান নতুন আবাসিক এলাকায় থাকি। আমার দাদীর তেমন কোন রোগে ভোগছিল না, শুধু মাত্র পায়ে এক ধরনের এলার্জি ছিল।আমার দাদীর পেট ব্যাথা, বমি ও পাতলা পায়খানা হচ্ছিল বলে ভয়ে আমি ও আমার ফোপাতু ভাই রাসেল ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে আসি কিন্তু এসে আমার জীবনের করুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। করোনা রোগী বলে হাসপাতালে ভর্তি করছে না, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পায়ে ধরে বলার পরেও হাজার ফোন এর উপর ফোন করে ভর্তি করানো হয়। ভর্তি পর ডাক্তারের অবহেলা দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। এরপর ওনারা রোগীকে এক্সরে আর সিটি স্ক্যান করে নিয়ে আসেন। এক্সরে আর সিটি স্ক্যান করলে নাকি করোনার পসিবিলিটি বুঝা যায়! রোগীকে নিয়ে ল্যাবে দৌড়াতে থাকি। সিটি স্ক্যান, এক্সরে করে বলে উনার করোনা পজিটিভ। ডাক্তার এর এমন মন্তব্যে সবাইকে চমকে দেই। নার্স এসে বলে অক্সিজেন এখানো নিয়ে আসেননি তাড়াতাড়ি অক্সিজেন দিতে হবে। কিন্তু আমার দাদীর এক তিল পরিমাণ শ্বাসকষ্ট ছিল না। সব দিকে ছোটাছুটি করে শেষমেশ গ্রাম থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসে অক্সিজেন এর ব্যবস্থা করি। তারপরও একটি ডাক্তার আমার দাদীকে ভালো মতো দেখল না উনার কি সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসা না করে শুধু বলে অক্সিজেন ব্যবস্থা করতে আর করোনা পরিক্ষা করাতে।
২৩ জুন বিকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরিক্ষা করার জন্য ৩৫০০/- টাকা নিয়ে নমুনা নেয়! কিন্তু তার ২ দিন পর সন্ধ্যায় (২৫ জুন, বৃহস্পতিবার) নমুনা আর টাকা ফেরত দিয়ে বলে ওনাদের পক্ষে টেস্ট করানো সম্ভব না আমাদের নিজ উদ্যোগে করার জন্য বলে (তাহলে ২টা দিন কেন নষ্ট করল)! এর কোন জবাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেই নাই। ইমন আরো জানান, আমরা কোন উপায় না দেখে এই হাসপাতালে ঐ হাসপাতালে করোনা টেস্ট করতে ঘুরতে থাকি কিন্তু কোন হাসপাতাল করোনা টেস্ট নিচ্ছে না কোন উপায় না পেয়ে আমার আংকেল সাংবাদিক মোহাম্মদ ফিরোজ এর এক বন্ধু এন এস আই এর সহযোগিতায় ২৭ জুন সন্ধ্যা ৬ টায় নতুন করে নমুনা নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল এ করোনা টেস্ট এর জন্য পাঠায়। কিন্তু ন্যাশনাল কতৃপক্ষ রিপোর্টের তোয়াক্কা না করে ওনাদের সিটি স্ক্যান রিপোর্ট এর উপর ভিত্তি করে আমার দাদীকে করোনা ইঞ্জেকশন (Remivir 100) সহ আরো অন্যান্য ইঞ্জেকশন দিতে থাকে সাথে বিভিন্ন ধরনের Antibiotic, Medicine তো আছে। আমার দাদীর প্রাথমিক কোন শ্বাসকষ্ট ছিল না, কিন্তু ওখানে ভর্তি হওয়ার পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়! অক্সিজেন এর উপর অক্সিজেন দিয়ে শ্বাসকষ্ট কন্ট্রোল করা যাচ্ছেনা।
২৭ জুন রাত ১০.৩০ মিনিটে আমাদের একপ্রকার মানসিক চাপ দেয় ICU তে শিফট করানোর জন্য! আমরা বাধ্য হয়ে ICU তে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। এরপর ICU থেকে আর ফিরে এলোনা! ২৮ জুন ভোরে তিনি মারা যান, অথচ ICU তে নেওয়ার আগেও ওনি কথা বলছেন ঠিক ঠাক। তখনও তার তেমন শ্বাসকষ্ট ছিল না। ন্যাশনাল হসপিটাল আমাদের ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে; ডায়াগনোসিসঃ কোভিড সাসপেক্টেড (Covid-19 Suspected) , মারা যাওয়ার কারণঃ কার্ডিওরেসপিরেটরি ফেইলিউর (হৃৎক্রিয়া/শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া)!
ইমন আরো জানান, ওনার দাদী মারা যাওয়ার ১০ দিন পর (৭ জুলাই) রোগীর করোনা রিপোর্ট পেয়েছে ‘নেগেটিভ’৷ অর্থাৎ মরহুমা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না৷ রিপোর্ট হাতে পেয়ে মরহুম হাজী ছুরা খাতুন এর পরিবারের বলছিলেন, ‘‘এই রিপোর্ট দিয়ে আমরা এখন কী করবো? আমরা তো আর উনাকে বাঁচাতে পারিনি! এই রিপোর্টের জন্য কেন ন্যাশনাল হাসপাতাল তালবাহানা করল! আর কেনই বা এইভাবে করোনা রোগী না হয়েও উনাকে করোনার ইনজেকশন দেওয়া হল। শুধু এক ছুরা খাতুন নয় প্রতিদিন অনেক রোগীর এই অবস্থায় মৃত্যু বরণ করছে ডাক্তার আর কর্তৃপক্ষের অবহেলায়।
চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালের এই রকম অভিযোগ শুধু করোনা কালে নয় সবসময় স্বাভাবিক অবস্থায়ও এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে প্রতিনিয়ত। ভাংচুর হয়েছে অনেকবার তারপরও প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে দিনের পর দিন তাঁরা চিকিৎসা নামে অবহেলা করে মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। রোগী স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও আইসিইউতে নিয়ে গিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসহায় মানুষের কাছ থেকে। তারা সঠিক চিকিৎসা দিচ্ছে না। যথাযথ তদন্তপূর্বক এই হাসপাতালে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জোর দাবি জানান তারা। আর যেন কারো মায়ের বুক খালি না হয়, আর কারো মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন যেন চিকিৎসার নামে হয়রানির শিকার না হয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের পর গত দুই মাসে অনেকে এভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷ কিছু মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে৷ কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বজন হারানোর বেদনার কথা তুলে ধরেছেন, প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ৷ কিছু মৃত্যু আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে