এপিএস আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে ভারতীয় এবং চিনা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর চিনের সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক হু জিজিং একটি টুইট করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ভারতের জনগণের দু’টি ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া উচিত।
১) ভারতকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করা থেকে বিরত রাখতে চিন কী করতে পারে তা লঘু করে দেখা।
২) ভারত চিনকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারে।
হু জিজিং-এর এই টুইটে খুব স্পষ্ট ভাবেই ছিল চিনের সামরিক শক্তির আস্ফালন। কিন্তু বাস্তবে কি ছবিটা এই রকমই সত্যি? চিন গত ক’দিনে গ্লোবাল টাইমসের মাধ্যমে তাদের সামরিক শক্তির প্রদর্শনী করে যে ভাবে মানসিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, তার সঙ্গে কতটা মিল রয়েছে ভারত-চিন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) বরাবর ‘চিনা ড্রাগনের’ বাস্তব সামরিক শক্তির? ঘটনাচক্রে, লাদাখে দু’দেশের খটাখটি লাগার কিছু দিন আগেই, এ বছর মার্চ মাসে, হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টারের সমর বিশেষজ্ঞরা একটি তুলনামূলক বিচার করেছিলেন এশিয়ার দুই প্রবল শক্তিধর প্রতিপক্ষ ভারত এবং চিনের সামরিক শক্তি নিয়ে। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে, বেলফারের দুই বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক ও’ডোনেল এবং অ্যালেক্স বলফ্রাস বিস্তারিত আলোচনা করেছেন— প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে ভারত-চিন সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে কোন দেশ সামরিক শক্তিতে কোথায় কতটা এগিয়ে তা নিয়ে। ডোকলাম সঙ্কটকে পরিপ্রেক্ষিতে রেখেই এই তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছিল।
২০১৯-এ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই বাহিনীর সংঘর্ষ, ছবি:পিটিআই
একই রকম ভাবে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি (সিএনএএস) নামে একটি গবেষণা সংস্থাও একই রকম তুলনামূলক আলোচনা করেছিল। বেলফার সেন্টার এবং সিএনএএস প্রকাশিত এই দুই বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, সমর সম্ভার থেকে শুরু করে যুদ্ধ পারদর্শিতায় এই মূহুর্তে ভারত এবং চিনের তুলনামূলক অবস্থান।
স্থলবাহিনী
বেলফারের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে— প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চিনের মোকাবিলা করতে ভারত অন্তত ২ লাখ ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করতে সক্ষম। তার মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডে সেনা সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার। এর মধ্যে লাদাখে রয়েছে টি-৭২ ব্রিগেডের ১৫০টির মতো ট্যাঙ্ক এবং ৩০০০ বাহিনী। এ ছাড়াও রয়েছে অষ্টম মাউন্টেন ডিভিশন এবং তৃতীয় ইনফ্যান্ট্রির সেনারা।
মধ্যাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে রয়েছে ষষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রায় ১৬ হাজার সেনা।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে চিনা সীমান্তে রয়েছে ভারতীয় সেনার ৯টি মাউন্টেন ডিভিশনের প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার সেনা। তার সঙ্গে রয়েছে অরুণাচলের ব্রহ্মস মিসাইল রেজিমেন্ট।
উল্টো দিকে চিনের শিনচিয়াং মিলিটারি ডিসট্রিক্ট এবং তিব্বত মিলিটারি ডিসট্রিক্টে মোতায়েন রয়েছে প্রায় ৭০ হাজার সেনা। এর মধ্যে বড় অংশই বর্ডার ডিফেন্স রেজিমেন্ট বা সে দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। সেই সঙ্গে চিনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার গোলন্দাজ আর পদাতিক সেনা যোগ করলে তা ভারতের সেনা সমাবেশের প্রায় সমান।
কিন্ত সিএনএএস রিপোর্ট পদাতিক বা গোলন্দাজ বাহিনীর সম্মুখ সমরের দক্ষতায় এগিয়ে রেখেছে ভারতীয় বাহিনীকে। তার কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ভারতীয় বাহিনী নিয়মিত সন্ত্রাস দমন অভিযানের সঙ্গে যুক্ত। অন্য দিকে ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ ওই রকম উচ্চতায়, প্রতিকূল পরিবেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পারদর্শিতা এবং অভিজ্ঞতাকে অনেকটা বৃদ্ধি করেছে।
অন্য দিকে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের সঙ্গে সংঘর্ষ ছাড়া চিনা বাহিনীকে বড় কোনও সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়নি। ওই লড়াইয়ে ভিয়েতনামের বাহিনীর কাছে রীতিমতো পর্যুদস্ত হয়েছিল চিনা বাহিনী। ফলে তুলনামূলক বিচারে ভারতকেই এগিয়ে রাখছে এই রিপোর্ট।
এ ছাড়াও, সম্প্রতি ভারতীয় বাহিনীতে চিনুক, অ্যাপাশের মতো হেলিকপ্টার যুক্ত হওয়ায় সেনার ক্ষমতা অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস এবং সি-১৭ গ্লোবমাস্টারের মতো বিমান প্রত্যন্ত এলাকায় বাহিনীর রসদ জোগানো এবং লজিস্টিক সাপোর্ট পৌঁছতে খুবই কার্যকরী।
ভারত বনাম চিন বিমান বহর
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে চিনা বিমান বাহিনী ভারতের বিমান বহরের থেকে সংখ্যা এবং গুণগত দু’দিক থেকেই পিছিয়ে বলে দাবি গবেষকদের।
চিন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অংশটি চিনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের আওতাধীন। সেখানকার রীতি অনুযায়ী, ওই পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত বিমান বাহিনীও। ওই কমান্ডের অধীনে ১৫৭টি যুদ্ধবিমান, বোমা ফেলতে বা আক্রমণ করতে সক্ষম চালকহীন বিমান, ড্রোন রয়েছে। কিন্তু তার একটা বড় অংশই রাশিয়ার জন্য সংরক্ষিত। অর্থাৎ রুশ ফ্রন্ট থেকে কোনও আক্রমণ হলে তা রোখার জন্য বিশেষ ভাবে রাখা রয়েছে ওই বিমান বহরের একটি বড় অংশ।
কিন্তু ভারত বিমান বাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয়, মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্তত ২৭০টি যুদ্ধবিমান এবং ৬৮টি গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফ্ট বিমানবাহিনী ব্যবহার করতে পারে চিনের নিয়ন্ত্রণরেখায়।
গালওয়ান সংঘর্ষের পর লেহ বিমানঘাঁটি থেকে উড়ছে ভারতীয় যুদ্ধবিমান। ছবি: পিটিআই
গুণগত দিক থেকেও ভারতের চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটারের সংখ্যা চিনের তুলনায় এই অংশে বেশি। চিনের জে-১০ এবং জে-১১ ফাইটার বিমানগুলির সমকক্ষ ভারতের মিরাজ-২০০০। কিন্তু ভারতের সুখোই-৩০ এমকেআই, চিনা চতুর্থ প্রজন্মের বিমানের থেকে আরও বেশি আধুনিক এবং কার্যকরী।
লজিস্টিক বা অবস্থানগত ভাবেও চিনের থেকে এই অংশে ভারত এগিয়ে, দাবি বেলফার রিপোর্টের। চিনের বিমানঘাঁটিগুলির প্রত্যেকটিই তিব্বত এবং জিংজিয়াং প্রদেশে অত্যন্ত উঁচু উপত্যকায়, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব কম। সেখানে চিনা বিমান বহর সাধারণ মাত্রার থেকে অর্ধেক অস্ত্র সম্ভার এবং জ্বালানি বহন করতে পারবে। এ ধরনের আটটি বিমানঘাঁটি রয়েছে চিনের। যার মধ্যে বেশিটাই অসামরিক। এই রিপোর্টে আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, চিনের হাতে মোট ১৫টি ট্যাঙ্কার বিমান রয়েছে যা দিয়ে আকাশে বিমানে জ্বালানি ভরা সম্ভব। প্রয়োজনের তুলনায় এটা অনেক কম।
অন্য দিকে গত তিন দশকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতের বিমান ঘাঁটি এবং সামরিক বিমানবন্দরের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অবস্থানগত ভাবে সেই বিমানঘাঁটিগুলো অনেক সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থিত। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর লাদাখ এবং অরুণাচলে এমন অনেক বিমান ঘাঁটি রয়েছে (অ্যাডভান্স ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড), যা অবস্থানগত ভাবে ভারতীয় বিমান বহরকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে।
গবেষকদের দাবি, কৌশলগত দিক থেকেও এগিয়ে ভারতীয় বিমানবহর। তাঁরা চিনা বিমানবহরের মহড়ার একটি সাম্প্রতিক ভিডিয়ো বিশ্লেষণ করে দাবি করেছেন, চিনা পাইলটরা অনেক বেশি নির্ভরশীল গ্রাউন্ড কমান্ডের উপর। অর্থাৎ বিমানঘাঁটি থেকে দেওয়া নির্দেশের উপরেই তাঁরা বেশি নির্ভর করেন। কিন্তু প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা, যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রগুলির একটি বলে বর্ণনা করা হয় উচ্চতা-ভৌগলিক অবস্থান-প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে, সেখানে বাস্তবের যুদ্ধে পাইলট সব সময় বিমানঘাঁটির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক। ভারতীয় বিমানবহরের পাইলটরা মাটি থেকে আসা নির্দেশের উপর ততটা নির্ভরশীল নন, তা বালাকোট পরবর্তী আকাশযুদ্ধের মহড়া থেকে অনেকটাই স্পষ্ট। অর্থাৎ, পাইলটদের প্রতিকূল পরিবেশে অপারেশন চালানোর ক্ষেত্রে ভারতীয় বৈমানিকদের এগিয়ে রেখেছে এই রিপোর্ট। ওই রিপোর্টে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক শীর্ষ আধিকারিককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে— ফাইবার গ্লাস শিট এবং দ্রুত জমাট বাঁধতে পারে এমন রিইনফোর্স কংক্রিটের সাহায্যে যে কোনও ক্ষতিগ্রস্ত রানওয়েকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে ফের কর্মক্ষম করে তোলার প্রযুক্তি রয়েছে ভারতের হাতে। ফলে ভারতীয় বিমানবহরকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা কঠিন।
নৌবাহিনী
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার লড়াইয়ে সরাসরি যুক্ত না হলেও, চিনের সঙ্গে সম্মুখ সমর হলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে ভারতীয় নৌবহরও। ১৩৭টি যুদ্ধজাহাজ এবং ২৯১টি বিমান রয়েছে ভারতীয় নৌবহরের অধীনে। রয়েছে পরমাণু জ্বালানিতে চলা সাবমেরিনও।সিএনএএসের দাবি, সম্প্রতি ভারত মহাসাগরে শক্তিবৃদ্ধি করছে চিনা নৌবহর। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একাধিক চুক্তির ফলে ভারতীয় নৌবহর ভারত মহাসাগরে যে কোনও যুদ্ধ জাহাজের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উপগ্রহ চিত্র হাতে পায়। ফলে ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবহরেরও ভাল উপস্থিতি রয়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ চিন সাগরে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি অনেকাংশেই চিনের সমুদ্র বাণিজ্যে ব্যাঘাত তৈরি করতে পারে। কয়েক দিন আগে ফোর্বস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত-চিন উত্তাপ বৃদ্ধির মধ্যেই ভারতীয় নৌবহর নীরবে স্ট্র্যাটেজিক লোকেশনে শক্তিবৃদ্ধি করছে। আয়তনে চিনা নৌবহর ভারতের তুলনায় অনেক বড় হলেও, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নৌবহর সঙ্কীর্ণ মলাক্কা প্রণালীতে নজরদারি বাড়িয়েছে। মলাক্কা প্রণালী কৌশলগত দিক থেকে চিনা নৌবহরের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। অন্য দিকে চিনা নৌবহরের বড় অংশই ব্যস্ত দক্ষিণ চিন সাগরে, যেখানে চিনের বন্ধু রাষ্ট্রের থেকে শত্রুর সংখ্যা বেশি। গত ৪৮ ঘণ্টায় সেখানে চিনা নৌবহরের ব্যস্ততা বাড়িয়েছে মার্কিন নৌবহরের উপস্থিতি। যা ভারত-চিন সঙ্ঘাতের এই পর্বে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করছেন সমর বিশেষজ্ঞরা।
ভারত-চিন দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর
বেলফার সেন্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে চিনের অন্তত ১০৪টি পরমাণু বোমাবাহী ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল আছড়ে পড়তে পারে। চিনের হাতে দুরপাল্লা থেকে শুরু করে মাঝারি এবং স্বল্প পাল্লার ভূমি থেকে ভূমি, সাগর থেকে ভূমি, বা আকাশ থেকে ভূমি— নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রর মহড়া। ছবি: পিটিআই
অন্য দিকে ভারতের হাতেও রয়েছে বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু গবেষকদের দাবি, সেগুলোর বেশির ভাগটাই পাকিস্তানমুখী এবং অবস্থানগত ভাবে পাকিস্তানের কাছাকাছি। বেলফারের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ১০টি অগ্নি-৩ মিসাইল চিনের মূল ভূখণ্ডের যে কোনও অংশে আঘাত হানতে পারে। আরও ৮টি অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য চিন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। অর্থাৎ ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের ক্ষেত্রে চিনকে এগিয়ে রেখেছেন ওই দুই গবেষক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম দুই স্কোয়াড্রন জাগুয়ার আইএস ফাইটার এবং মিরাজ ২০০০ এইচ যুদ্ধবিমান তিব্বত পর্যন্ত সফল অপারেশন চালাতে সক্ষম হলেও, চিনের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে অপারেশন চালাতে পারবে না। তবে সেই সঙ্গে গবেষকরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ভারতীয় বাহিনী তাঁদের ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার আরও বিভিন্ন জায়গায় রেখেছে, যা প্রকাশ্যে আসেনি। সেখান থেকে চিনকে আকস্মিক আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের।
দু’দেশের সমর সম্ভারের এই তুলনামূলক বিচারে, বেলফার এবং সিএনএএস রিপোর্ট— দুই জায়গাতেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের জিডিপির হিসাবে চিনের সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ ভারতের থেকে বেশি। সেনা সংখ্যায় চিন পৃথিবীর এক নম্বরে, ভারত তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে। কিন্তু চিনের সামরিক অভিমুখ বা ফোকাস মূলত আমেরিকা এবং তার বন্ধু দেশগুলোকে ঘিরে। তার বাইরে এশিয়ার এই সুপার পাওয়ার জাপান, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান বা রাশিয়ার মোকাবিলায় যতটা সামরিক শক্তি বা সমর সম্ভার তৈরি রেখেছে, ততটা তৈরি নয় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত সীমান্তে।
কিন্তু চিন ক্রমশ আরও সতর্ক হচ্ছে ভারত সম্পর্কে। কয়েক বছর আগে ডিপ্লোম্যাট পত্রিকায় জাপান ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক আয়ান ইস্টন তাঁর নিবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন— চিনের বাহিনীর আয়তন এবং সংখ্যার সঙ্গে বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রে পারদর্শিতার অনেক ফারাক আছে। কারণ কোরিয়া যুদ্ধের পর চিন কার্যত কোনও পুরোদস্তুর যুদ্ধ লড়েনি। এই প্রসঙ্গে সিএনএএসের রিপোর্টেও উল্লেখ, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বাহিনী বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সব বাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়া দিয়েছে এবং ভারতীয় বাহিনীর পারদর্শিতা সমীহ আদায় করে নিয়েছে গোটা বিশ্বের। চিন সেখানে রাশিয়া ছাড়া আর কোনও বড় শক্তিধর দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়া দেয়নি। আয়ান ইস্টনের বিশ্লেষণে, চিনের সবচেয়ে বড় শক্তি প্রায় ১ হাজার ৬০০ ক্রুজ এবং ব্যালাস্টিক মিসাইল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ওই মিসাইল হেনে প্রাথমিক ভাবে বড় ধাক্কা দিতে সক্ষম চিন। চিনের আরও একটি বড় শক্তি তাদের সাইবার আর্মি। পৃথিবীর বৃহত্তম সাইবার আর্মি চিনের। সঙ্গে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ড্রোনের সম্ভার। আয়ানের ইঙ্গিত, চিরাচরিত যুদ্ধের চেয়ে চিন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ্য অচিরাচরিত যুদ্ধে। তবে আয়ানের একটি পর্যবেক্ষণ ইঙ্গিতবাহী— বিশ্বের অন্য যে কোনও বাহিনী যে সময় ব্যয় করে মহড়া এবং প্রশিক্ষণে, তার অনেকটাই সময় চিনা বাহিনী ব্যয় করে চিনা কমিউনিষ্ট পার্টির গঠন, বিন্যাস এবং আদর্শ বুঝতে।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনা সমাবেশের উপগ্রহচিত্র। ছবি সৌজন্য: প্ল্যানেট ল্যাব
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক বিশেষজ্ঞই আর একটা বিষয়ের দিকে আলোকপাত করছেন। তা হল— এত দিন চিন ভারতের দিকে যতটা নজর রাখছিল, বর্তমানে তা বাড়াচ্ছে। হাডসন ইনস্টিটিউটের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ইঙ্গিত, মধ্য এশিয়াতে মার্কিন উপস্থিতি চিনের আশঙ্কার বড় কারণ। আর সেই সঙ্গে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যত বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক হচ্ছে, ততই ভারত সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠছে বেজিং। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের শক্তিবৃদ্ধিতে প্রধান বাধা ভারত। আর তাই ধীরে ধীরে চিনের রণকৌশলে গুরুত্ব বাড়ছে ভারতীয় সীমান্তের। চিনের সেই আশঙ্কার প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চিনের মনোভাবে। প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে নেপালের সঙ্গে চিনের বন্ধুত্বেও। চিন সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটানের সঙ্গেও। সূত্রঃ আনন্দ বাজার