করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারিতে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। এখনো এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে অনেক দেশ। এরই মধ্যে যেসব দেশে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে এসেছে, সেসব দেশও এখন শঙ্কায় আছে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বা মহামারির পরের পর্যায়ের ধাক্কাটা কেমন হবে তা নিয়ে। কেননা অতীতে বড় ধরনের মহামারির আবার ফিরে আসার ইতিহাসও রয়েছে।
গত শতাব্দীতে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির দ্বিতীয় ধাপ প্রথমটির চেয়ে বেশি ভয়াবহ ছিল। সে হিসেবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বা তরঙ্গ কি আসতে পারে? যদি আসে, তাহলে এর মাত্রা কতটা খারাপ হতে পারে? ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রথমত, সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ কী?
এটাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভাবা যেতে পারে। সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর আবার কমে আসে, এই চক্র একটি ঢেউ। সংক্রমণ আবার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়াটা হবে দ্বিতীয় ঢেউ।
ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মাইক টিল্ডসলে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক কোনো সংজ্ঞা নেই। কেউ কেউ মহামারির প্রকোপ কমার পর একটু বেড়ে গেলেই তাকে দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে ধরেন। কিন্তু আসলে তা প্রথম পর্যায়েরই অংশ। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে এবং আক্রান্তের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেলে একটি পর্যায় বা ঢেউ বা ধাক্কা শেষ হয়ে গেছে বলা যাবে।
দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়তে হবে। নিউজিল্যান্ড ২৪ দিন করোনাভাইরাসমুক্ত থাকার পর আবার দেশটিতে কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। চীনের রাজধানী বেইজিং ৫০ দিন ভাইরাসমুক্ত থাকার পর আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এগুলোকে মহামারির দ্বিতীয় পর্যায় বা দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায় না।
তবে বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন, ইরানে আবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াটা মহামারির সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় পর্যায় হতে পারে।
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় পর্যায় আসার আশঙ্কা নিয়ে ড. টিল্ডসলে বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে সত্যিই মনে করি যে এ নিয়ে বিশাল অনিশ্চয়তা আছে। তবে সত্যি কথা বলতে কী, এটা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন।’
ভাইরাস এখনো চারপাশে রয়েছে এবং এটি এ বছরের শুরুর চেয়ে কম মারাত্মক বা সংক্রামক হয়ে যায়নি। তাই মহামারির দ্বিতীয় পর্যায় আসার আশঙ্কা স্পষ্ট। এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর তারা যে আবার এ ভাইরাসে আক্রান্ত হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
লন্ডনের হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের ডা. অ্যাডাম কুচারস্কি বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ এখনো সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমরা সব বিধি-নিষেধ তুলে নিলে ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে যাব। এটি আবার শূন্য থেকে শুরু করার মতো।’
দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা কিভাবে হবে?
লকডাউনের বিধি-নিষেধ দ্রুত তুলে ফেললে দ্বিতীয় পর্যায় দেখা দিতে পারে। লকডাউন বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটিয়েছে, বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে, শিশুদের স্কুল থেকে দূরে রেখেছে। তবে তাতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও হয়েছে। ডা. কুচারস্কি বলেন, ‘চূড়ান্ত ধাঁধা হলো দৈনিক কাজে বিঘ্ন না ঘটিয়ে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়।’
এভাবে কতদূর যাওয়া যাবে তা নিয়ে কেউ শতভাগ নিশ্চিত নন। এ জন্যই কয়েকটি ধাপে লকডাউনের বিধি-নিষেধ তোলা হচ্ছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের নতুন নতুন উপায় চালু করা হচ্ছে।
ডা. কুচারস্কি বলেন, নিয়ন্ত্রণ বজায় না রেখে বিধি-নিষেধ শিথিল করা হলে যুক্তরাজ্য এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে হঠাৎ প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে।
জার্মানিতে এরই মধ্যে প্রাদুর্ভাব বাড়ার উদাহরণ দেখা গেছে। দেশটিতে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি কারখানায় এক হাজারের বেশি কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
যদি ক্লাস্টারগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা যায়, স্থানীয়ভাবে লকডাউন চালু হয় এবং ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হয়তো বড় কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তা না হলে এগুলোই দ্বিতীয় পর্যায়ের মহামারির সূচনা ঘটাবে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশংসিত দক্ষিণ কোরিয়া এ জাতীয় ক্লাস্টারের কারণে কিছু বিধি-নিষেধ আবার জারি করেছিল।
দ্বিতীয় পর্যায় কি প্রথমটির মতো হবে?
যদি সে রকম হয়, তবে তা হবে মানুষের গুরুতর কোনো ভুলের জন্য। মহামারি শুরুর দিকে একজন আক্রান্ত মানুষ থেকে গড়ে তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে। এর অর্থ ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। তবে এখন মানুষের আচরণ বদলেছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সচেতনতা বেড়েছে। তাই সংক্রমণের গতি এবার বেশি হবে না বলে ধরে নেওয়া যায়।
ডা. কুচারস্কি বলেন, কোনো দেশ এখন সব বিধি-নিষেধ তুলে নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে না। এমনকি ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশ, যেখানে করোনাভাইরাস মহামারির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানেও এখন একজন থেকে তিনজনে ভাইরাস ছড়াচ্ছে না।
দ্বিতীয় পর্যায়ে যদি আবার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে, তবে তা হতে পারে অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে। তবে তাত্ত্বিকভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা এখনো প্রথমবারের চেয়ে বেশি হতে পারে, কারণ বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো ঝুঁকিতে আছে। ড. টিল্ডসলের মতে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে আবার লকডাউনে যেতে হবে।
শীতকালে কি পরিস্থিতি খারাপ হবে?
ডা. কুচারস্কি মনে করেন, স্থানীয়ভাবে ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা দিতে পারে যেকোনো সময়। তবে এর মানে এই নয় যে এটাই দ্বিতীয় পর্যায়। ড. টিল্ডসলে বলেন, ‘যদি বিধি-নিষেধ উল্লেখযোগ্যভাবে শিথিল করা হয় তবে আমরা হয়তো আগস্টের শেষের দিকে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে দ্বিতীয় পর্যায় দেখব।’
আগামী শীত মৌসুম গুরুত্বপূর্ণ সময় হতে পারে। কারণ অন্যান্য করোনাভাইরাস ওই সময় সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, ‘বসন্ত (ইউরোপে করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর সময়) নিঃসন্দেহে আমাদের সহায়তা করেছিল। দ্বিতীয় পর্যায় প্রায় অনিবার্য, বিশেষ করে যখন আমরা শীতের মাসগুলোতে যাব।’
ভাইরাস কি দুর্বল হয়ে পড়বে?
দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মারাত্মক হবে—এর বিপক্ষে একটি যুক্তি হচ্ছে আরো ভালোভাবে মানুষকে সংক্রমিত করতে নিজেদের বদলাতে গিয়ে ভাইরাসগুলো সাধারণত কম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এমনকি এইচআইভিও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভাইরাসগুলো যদি মানুষকে না মারে, তবে তারা আরো ছড়াতে পারবে। তাই তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে অধ্যাপক বল বলছেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছু ভাইরোলজিস্ট দেখিয়েছেন এটা খুবই ধীর প্রক্রিয়া।
ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলা মহামারিতে নতুন এই করোনাভাইরাসের শক্তি কমেছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি।