অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত শত শত ফিলিস্তিনি পরিবার এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার নতুন সংগ্রামে লিপ্ত। মে মাসে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর মেরামত করে আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করছে। ১১ দিনের ঐ হামলায় বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বজন হারানোর বেদনাও ফিলিস্তিনিরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যে কোনো নির্মাণকাজের জন্য প্রয়োজন অর্থ। ফিলিস্তিনিদের জন্য এখন অর্থ সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো সূত্র থেকেই ঋণ মিলছে না। ইসরাইল মূলত অধিকৃত ভূখণ্ডের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য পালটে দিতে চেয়েছে।
রামাল্লার উত্তরাঞ্চলীয় জনপদ সুরমাসিয়া। প্রচুর বিলাসবহুল বাড়ি সেখানে ছিল। কারণ বাসিন্দাদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ফিলিস্তিনি। মুন্তাসির শালাবি সেখানকার এক স্থানীয় বাসিন্দা, যার মার্কিন নাগরিকত্বও ছিল। তা সত্ত্বেও একজন ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীকে গুলি করে হত্যা ও দুজনকে আহত করার অভিযোগে ইসরাইলিরা তাকে মে মাসে হত্যা করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি পশ্চিম তীরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এক চেকপোস্টে ঐ হামলা করেছিলেন।
ইসরাইলি বাহিনী শুধু তাকে হত্যাই করেনি বরং তার বাড়িটিও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মুন্তাসিরের স্ত্রী ও তিনটি সন্তান রয়েছে। তারা ৮ জুলাই নিজেদের বাড়ি ফিরে এসে তার ধ্বংসস্তূপ দেখেছে। ইসরাইল এখন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘যৌথ শাস্তি’র নীতি গ্রহণ করেছে। যার অর্থ কেবল আক্রমণকারীকেই নয় তার পরিবারকেও ভোগান্তির শিকার হতে হবে।
আইনগত পদক্ষেপ এবং মার্কিন দূতাবাসের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও ইসরাইল ঐ নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। মুন্তাসিরের স্ত্রী ৪০ বছর বয়সি সানাহ শালাবি ও তাদের ছেলেমেয়েরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো হামলায় অংশ না নিলেও তারা এখন এর মাশুল গুনছে। যৌথ শাস্তি নীতির পক্ষে ইসরাইলের কথা হলো তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হলে এর জন্য পরিবারকেও যে তার মূল্য দিতে হবে সেটা ফিলিস্তিনিরা বুঝুক। এর মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতন করতে পারবে যে কেউ যেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো রকম সহিংসতায় অংশ না নেয়। এই নীতির আওতায় তারা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ধ্বংস করা অব্যাহত রেখেছে। অথচ তথাকথিত যৌথ শাস্তির এই নিয়ম আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
তবে ইসরাইলি অধিকার গ্রুপ বি’ সেলেম জানিয়েছে, কয়েক বছর ধরে এ কাজ করে যাচ্ছে যার ফলে ধ্বংস হয়েছে শত শত বাড়িঘর, গৃহহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। একটি বিবৃতিতে গ্রুপটি জানায়, বাড়ি ধ্বংসের বিষয়ে রাষ্ট্র এখনো পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেনি। প্রকৃত প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের হামলা বন্ধ করা বা এর বিরুদ্ধে তাদের ওপর চাপ তৈরি করা কোনোটিই অর্জিত হয়নি। কার্যকারিতা প্রমাণ করা ছাড়া অমানবিক পন্থা একতরফাভাবে সমর্থন করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এর ফলে হামলা কমেনি বরং ফিলিস্তিনিরা বেশি করে হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি এমন শাস্তি অবশ্য ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়নি, যারা ফিলিস্তিনিদের ক্রমাগত আঘাত হেনে চলেছে। সানাহ ও মাকে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শাবাক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা হয়নি। সম্ভবত তাদের আমেরিকার নাগরিকত্ব ও মার্কিন দূতাবাসের হস্তক্ষেপের জন্য তাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তা সত্ত্বেও সব মিলিয়ে যা ঘটছে তাতে সানাহ খুবই আতঙ্কিত। সানাহর মা এলিজাবেথ খামিস বলেন, সানাহ অবসন্নতা ও মানসিক চাপে ভুগছে। তার ছেলেমেয়েরা মনে হয় নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তৈরি। তবে তারা তাদের মায়ের মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি বুঝতে অপারগ। তাদের বাবার বন্দিদশা, বাড়ি ধ্বংস হওয়া এই বিষয়গুলো ঠিক তাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি বসতিগুলোরও একই অবস্থা। সেখানকার জনপদ সিলওয়ানের বাসিন্দা নিদাল রাজাবির দোকানটি কয়েক সপ্তাহ আগে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি নির্মাণকাজ সীমিত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরাইল এ কাজ করেছে। অথচ একই সঙ্গে সেখানে এগিয়ে চলেছে ইহুদি বসতির নির্মাণকাজ। আন্তর্জাতিক আইনে সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ ও নির্মাণ দুটোই অবৈধ। ইসরাইলের কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যেই বলে থাকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদিদের জনসংখ্যা বাড়ানো তাদের অন্যতম নীতি। ভেঙে দেওয়া বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনির বিবিধ বাধার মুখে পড়ছে। এক দিকে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন মিলছে, অর্থায়ন করা যাচ্ছে না এবং নির্মাণসামগ্রী পাওয়াও তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ছে।