অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার শব্দটি একটি বহুল আলোচিত বিষয়।পুর্বে মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতেন হাতে গোনা বিশিষ্টজনেরা,বিশ্বে যাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে দেখলে এসব মনীষীগণ কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করতেন।তাদের প্রতিবাদ দেখে মানুষ সচকিত হত এবং লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হত। তাতে কাজও হত বেশ।পৃথিবীর চতুর্দিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেখে নিপীড়ক দূর্বৃত্ত তার নিষ্ঠুরতা থামিয়ে দিতে অথবা দৃষ্টিগ্রাহ্যরুপে কমিয়ে দিতে বাধ্য হতো। গত শতকের এমন সব মানবতাবাদীর মধ্যে যাদের নাম উচ্চারণ করা যায় তারা হলেন মহাত্মা গান্ধী, বার্ট্র্যান্ড রাসেল, মার্টিন লুথার কিং, রমা রোলা, এবং নেলসন ম্যান্ডেলা। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে এক কিংবা যৌথভাবে বিভিন্ন শো এবং টকশোতে প্রায় প্রতিদিন মানবাধীকার নিয়ে কথা হয়। এসব টকশোতে মূল্যবান ও অনুধাবনযোগ্য কথা উচ্চারিত হয় না এমন নয়। তবে বেশী বেশী উচ্চারিত না হওয়ার কারণেই সম্ভবত সেসব কথা ক্ষমতাধরদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাদের দ্বারা নির্বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘেনর ঘটনা ঘটেই চলে। তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের কাফেলা প্রতিবাদকারীদের ধ্বনি-প্রতিধ্বনির কারণে থেমে যায় না। এ কারণে সম্প্রতি বিশ্বের সবখানে মানবাধিকার লঙ্ঘটেনর ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই এবং টিভির পর্দায় চোখ রাখলে এর প্রমান মেলে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার আগে মানবাধিকার বলতে কী বোঝায় সে সম্বন্ধে একটু ধারণা নেয়া যাক। পৃথিবীতে প্রাণী মাত্রই বেঁচে থাকতে চায়,কেউ মরতে চায়না। ফলে বেঁচে থাকতে হলে খাবার প্রয়োজন। সহজে এবং সুলভে খাবার পাওয়ার অধিকার। অতএব খাবার পাওয়া এবং খেয়ে বেঁচে থাকার এই অধিকারটিকে মানবাধিকারের প্রথম ধাপ বিবেচনা করতে হবে। পৃথিবীতে জলবায়ু এবং আবহাওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোদ,ঝড়,বৃষ্টি প্রভৃতির বিরুপতা থেকে রক্ষা পেতে গেলে মাথার উপর ছাদ থাকা আবশ্যক। আগের যুগের মানুষ এসব থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের গুহায় এবং যেখানে পাহাড় থাকতোনা সেখানে বড় বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিত। এগুলো দূর্যোগ থেকে বাঁচতে পুরোপুরি সহায়ক ছিল না বলে প্রয়োজনের তাগিদে সে ঘর-বাড়ি তৈরি করে নিল এক সময়। ঘর-বাড়ি তৈরীর জ্ঞান তাকে এক যায়গায় আটকে পড়ে থাকার পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে দিল। সে স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছামত উপযুক্ত স্থানে বসবাসের সুযোগ পেল। মানুষের আরেকটি প্রয়োজন হলো কাপড়-চোপড়। পশু পাখির মত মানুষের শরীরে লোম ও পালক নেই। ঠান্ডা ও গরম থেকে রক্ষা পেতে তাকে দেহ ঢাকার জন্য আবরণ তৈরীর দরকার হলো। প্রথম প্রথম সে গাছের ছাল ও পাতা এবং পশু চর্মকে আবরণ হিসেবে ব্যবহার করতো। পরে গাছের আঁশ ও তন্তু দিয়ে কাপড় বানিয়ে পোশাক তৈরির জ্ঞান লব্ধ করে নিল।
পোশাকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল আরো একটি কারণে । জীব-জন্তু চার পায়ে হাঁটে আর মানুষ হাঁটে দু্ পায়ে। এই পার্থক্যের কারণে মানুষ তার লজ্জা নিবারনের জন্য পোশাকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বিধায় সেই তাগিদেই তার দেহাকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে এক সময় সে বাহারি পোশাক তৈরি করে ফেললো। এছাড়া খাওয়া,পরা,বসবাস ইত্যাদি কাজ সহজতর করতে তাকে এসব তৈরির জ্ঞান আয়ত্ব করতে হল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসব জ্ঞান হস্তান্তরের বা প্রবাহের জন্য শিক্ষাদান বা বিদ্যালাভের সুযোগ সৃষ্টি করতে হলো। একবার এসব সম্পন্ন হয়ে গেলে মানুষ অনেকটা নির্বিঘ্নে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার লাভ করলো। এর সাথে যোগ হল মানুষের রোগে-শোকে সুচিকিৎসা পাবার। সুতরাং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান,শিক্ষা ও চিকিৎসা- এই সকল মৌলিক চাহিদা সমূহ পূরণ করা বা প্রাপ্তী মৌলিক মানবাধিকারের আওতায় পড়ে।
এবার আসা যাক প্রচলিত সঙ্গায় মানবাধিকার কী? মানবাধিকার শব্দের অক্ষরিক অর্থ হলো মানবের অধিকার। মানবাধিকার বিষয়টি পুরো মানব জাতির সাথে সংশ্লিষ্ট । মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন,সহজাত ও অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার হলো মানবাধিকার। এসব অধিকারেরর মধ্যে পড়ে মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ নানান ধরনের অধিকার। যেমন– কথা বলার অধিকার,মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলা-ফেরা করার অধিকার,কাজ করার, মতামত ব্যক্ত করার,শিক্ষা ও জাতীয়তা পাবার অধিকার প্রভৃতি। পৃথিবীতে মানুষের জন্মগ্রহণের সাথে সাথে তার এ সকল মানবাধিকারের সূচনা হয়। সুতরাং এই অধিকার গুলোকে মানুষের সহজাত অধিকার বলা যায়। প্রতিটি মানব সন্তান মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েই হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে ক্রন্দন ধ্বনি উচ্চারণের মাধমে তার অধিকারের কথা সারা বিশ্বের কাছে জানিয়ে দেয়। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী।তবে সব মানুষ বুদ্ধি সম্পন্ন নয়। যারা বুদ্ধিমান তাদের দুটি অংশ। একটি অংশ জ্ঞানের বিকাশ ও উন্নতির হাতিয়ার ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং উন্নয়নে তাদের মেধা ব্যবহার করে। অর্থাৎ তাদের বুদ্ধি মানব কল্যাণে নিয়োজিত। অপর অংশটি তাদের বুদ্ধি ও মেধা কাজে লাগায় নিজ নিজ অথবা দলীয় স্বার্থকে এগিয়ে নিতে,প্যাঁচে ফেলে ও শক্ত প্রভাব খাটিয়ে তারা নিজেদের দেশের লোকদের তো বটেই উচ্চাভিলাসী হয়ে অন্য জনপদ ও দেশ দখল এবং কব্জায় নিয়ে তাদের সম্পদ লুটে খায়। এটা করতে গিয়ে তারা যে সব কাজ করে আধুনিক ভাষায় সেগুলোকে বলে মানবাধিকার লঙ্ঘণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভের আল্প কিছু দিনের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রাথমিক ভিত্তির দলিল সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (UDHR) গৃহিত হয়। বাধ্যবাধকতাহীন এই দলিলে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একনায়ক সুলভ ক্ষমতার ব্যবহার থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য মানবাধিকারের রুপরেখা তৈরী করা হয়েছিল। বিশ্বের সবগুলো মহাদেশের এবং ধর্মের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচিত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির দ্বারা গবেষণার মাধ্যমে এবং প্রতিটি অধিকার আলাদা অংশে বিভক্ত করে সর্বজনীন মানবাধিকার তত্ত্বটি প্রস্তুত হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার তত্ত্বে মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে; যা সমগ্র মানব সত্ত্বার সাথে জড়িত।সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (UDHR)-এর ১নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে যে,সকল মানুষই স্বাধীন অবস্থায় সম-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে।এর সাথে যোগ করা হয়েছে অর্থনীতি,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার।
উপরেরর আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, মানুষের সমস্ত অধিকার প্রকৃতিতে সহজাত ও হস্তান্তর অযোগ্য,যেগুলি পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জাতি,বর্ণ,গোত্র,নারী-পুরুষ,রাজনৈতিক বা অন্যান্য অভিমত ইত্যাদি নির্বিশেষে সমভাবে প্রযোজ্য ও উপভোগ্য (Equally applicable to and enjoyable by),যেগুলো মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং এগুলো ছাড়া মানুষ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারেনা সেগুলোই মানবাধিকার। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (UDHR) ছাড়াও সমগ্র বিশ্বে যে সকল আন্তর্জাতিক আইন ও সনদের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন (১৯৪৯) ২। মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপিয়ান কনভেনশন(১৯৫২) ৩। শরণার্থী অবস্থা সম্পর্কিত কনভেনশন (১৯৫৪) ৪। জাতিগত সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ কনভেনশন (১৯৬৯) ৫। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারেরর আন্তর্জাতিক চুক্তি (১৯৭৬) ৬। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (১৯৬৬) ৭। নারীর বিরুদ্ধে সকর প্রকার বৈষম্য দূরিকরণ কনভেনশন (১৯৮১) ৮। শিশু অধিকার কনভেনশন (১৯৯০) ৯। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার সনদ (২০০০) ১০। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার করবেনশন (২০০৭) ইত্যাদি।
মানুষের অধিকারের বিষয়টি যুগ যুগ ধরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে এসেছে। যেমন-আমার গৃহে নিরাপত্তাসহ নিরাপদে জীবন যাপন যেমন আমার অধিকার,প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন অবিবাহিত যুবক-যুবতীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও সন্তান উৎপাদনও তাদের তেমন অধিকার।সেন্সরশীপ আরোপ করে মত প্রকাশ,প্রচার ও কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঠিক তেমনি আইন সম্মত কারন ও পরোয়ানা ব্যতিরেকে কাউকে গ্রেফতার,আটক,নির্যাতন ও হয়রানী সবই মানবাধিকারের লঙ্ঘন আমাদের দেশের সংবিধানে এই বিষয়ে স্পষ্টরুপে বলা আছে। যদিও আমরা হর হামেশাই মানুষ গুম,খুন,অপহরণ হওয়ার কথা এমনকি খোদ এ দেশের আইন শংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মাঝে মাঝেই বিনা বিচারে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার করে মানুষ হত্যার মতো অভিযোগের কথা শুনে থাকি। যা কোনভাবেই একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য হতে পারে না।
সবশেষে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এরুপ একটি ঘটনাও যাতে আর না ঘটে সেই কামনা করছি।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, মেহেরপুর।
E-mail:mizanmpur06@gmail.com