ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি-
বাবা ঝাপিয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীনের যুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করে পেয়েছিলেন জাতীয় বীরের মর্যদা। এখন ছেলে যুদ্ধে নেমেছে অদৃশ্য শক্তি করোনার ভাইরাসের বিরুদ্ধে। বলছি ঝিনাইদহ জেলা শহরের কানঞ্চনপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদৎ হোসেন ও তার ছেলে ডা. লিমন পারভেজের কথা।
মহাসংক্রামক করোনা ভাইরাসকে ইতিমধ্যে বৈশি^ক মহামারি হিসাবে ঘোষণা করেছে জাতি সংঘের স্বাস্থ্য বিভাগ। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার এ ভাইরাসকে অতি ঝুকিপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুকি আছে জেনেও পরিবার পরিজন রেখে নেমেছেন করোনা যুদ্ধে। জীবনের ঝুকি নিয়ে দিন রাত রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাবার দুই সন্তানের মধ্যে ছোট লিমন পারভেজ। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হয়ে মানুষকে সেবা করবে।
করোনার এই মহামারিতে সম্মুখযোদ্ধা এই ডাক্তারাই। এখন পর্যন্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে বহু ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। জীবন উৎসর্গও করেছেন দেশের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। ছেলে জীবনের ঝুকি নিয়ে দেশের সেবায় কাজ করছেন। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে আদরের সন্তান শহীদও হতে পাড়েন। নাও ফিরতে পারেন মার কোলে। সবকিছু জেনেও কেমন লাগছে বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের। বর্তমান পরিস্থিতে ছেলের চিকিৎসা সেবা নিয়ে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা এই বাবার সাথে। ছেলের এমন বীরত্বে বাবার তো গর্বে বুক ভরে গেছে। তার মত ছেলেও এই যুদ্ধ জয় করে ঘরে ফিরবে এমনটাই প্রত্যাশা ডা. লিমন পারভেজের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদৎ হোসেনের।
এ প্রতিবেদককে ডা. লিমন পারভেজের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদৎ হোসেন তিনি জানান, একটু সচেতন হলেই এই করোনা রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। কিন্তু অনেক রোগীরা তাদের অনেক তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসছেন। কোথা থেকে কখন কি হয়ে যায় এটা নিয়ে আমরা একটু চিন্তিত। তারপরও সন্তানকে বলি তুমি কখনও ভয় পাবে না। সব সময় মন শক্ত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তোমার পাশে আমরা আছি। ছেলেকে সব সময় বলি লিমন তুমি আমার সন্তান। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার সন্তানকে এ যুদ্ধে তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করছি। ঠিক তেমনি তুমি এক যুদ্ধে নেমেছ। তুমি ডাক্তার হয়েছ মানুষের সেবা করার জন্য, দুস্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাড়ানোর জন্য। যেকোনো দুর্যোগকালে জাতীয় সংকট কালে, এ সময় মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে তোমাকে। যেভাবে আমি দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার সন্তান হিসেবে তুমি সেই ভাবেই দেশের জন্য কাজ করে যাবে। আমরা যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছি। তুমি দেশের সংকটময় এ মুহুর্তে করোনাযুদ্ধ জয় করে ঘরে ফিরবে এমন আশায় বুক বেধে বসে আছি।
ডা. লিমন পারভেজের মা মিসেস নাসিমা হোসেন জানান, বাংলাদেশে যখন করোনা শুরু হয়। সে সময় থেকেই পরিবাররে সবার কথা চিন্তা করে লিমন তার ১৫ মাসের এক মাত্র সন্তান শেহজাদ পারভেজ ও স্ত্রী ইশরাত আযম তিশাকে যশোরে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এমনকি ছেলে আমাদের থেকে আলাদা থাকার চেষ্টা করত। আমাদের ঝিনাইদহে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় তারপর থেকে ছেলে তো আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে না বললেই চলে। আমরা আমাদের বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকি আর ছেলে অনেকদিন হয়ে গেলো নিচ তলাই একটি রুমে একা থাকে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এসে আলাদাভাবেই তার রুমে চলে যায়। এরপর তার জামা কাপড় নিজে নিজেই সব পরিষ্কার করে। কতদিন হয়ে গেলো ছেলে আমাদের সঙ্গে খাবারও খায় না। আমি নিজে গিয়ে নিচের রুমে দুর থেকে তাকে খাবার দিয়ে চলে আসি। সন্তান কাছে থেকেও দূরে এটা যে কতটা কষ্ট আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তারপরও ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকি। আবার নিজের মনকে শক্ত করে। দেশের যে অবস্থা কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার পরিবার পর্যন্ত তার পাশে থাকছে না। এমন সময় তাদের একমাত্র ভরসা ডাক্তার। আমি ভাবি তারাও তো কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। তাদের পাশে আমার ছেলেকে যদি না পাঠায় তাহলে কিভাবে সুস্থ হয়ে মায়ের বুকে ফিরে যাবে তারা। এ যুদ্ধে লিমনের মনবল শক্ত করার জন্য তাকে বলি নিজের ভাই বা বোন ভেবে তুমি রোগীদের সেবা করবে। কোনো ভাবেই যেনো তাদের পাশ থেকে পিছিয়ে আসবা না। মায়ের দোয়া তোমার সাথে সব সময় আছে।
ডা. লিমন পারভেজ জানান, সে পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে পরিবার থেকে নিজেকে আলাদা রেখেছে। কয়েক মাস হয়ে গেল পরিবারের কাছে যান না তিনি। তিনি জানান, তার ১৫ মাসের একটি সন্তান ও স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছে তার বাবার বাড়িতে। মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয় স্ত্রী-সন্তানের সাথে। কান্না জড়িত কন্টে তিনি জানান ভিডিও কলে আমাকে দেখেই কোলে আসার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দেয় আমার সন্তান। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাকে একটু কোলে নিতে পারি না। আমার সন্তানকে খুব আদর করতে ইচ্ছা করে। বাবা হয়ে সন্তানকেও একটু কোলে নিতে পারছি না। এটা যে কত যন্ত্রনা কত কষ্টের কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন দেশের মানুষের কথা ভেবে এ যুদ্ধে যখন নেমেছি ইনশাল্লাহ সফল হবোই।
এপিএস/১৪মে/আব্দুল্লাহ/ঝিনাইদহ প্রতিনিধি-
০১৭২৯ ৮৩০৮৫৩