সব
facebook apsnews24.com
রাজনীতির ক্ষমতা তত্ত্ব - APSNews24.Com

রাজনীতির ক্ষমতা তত্ত্ব

রাজনীতির ক্ষমতা তত্ত্ব

রায়হান কাওসার

একটি রাজনৈতিক দলে মূলত চার ধরনের লোক থাকে। জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গ, নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক, ইকোনমিক ডোনারস এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স- এই চার ধরনের লোক একটি রাজনৈতিক দলকে সচল রাখেন নানাভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল মানে একটি বৃহৎ সংগঠন। একটি রাজনৈতিক দলে এই চার শ্রেণীর লোকজনের তুলনামূলক গুরুত্ব এবং অবদান বিষয়ক আলোচনাকে বলা যেতে পারে পাওয়ার থিওরি অব পলিটিকস বা রাজনীতির ক্ষমতা তত্ত্ব।

রাজনীতির ক্ষমতা তত্ত্ব অনুসারে, দলের প্রথম সারির লোকজন হচ্ছেন সেই দলের জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গ। মূলত তাঁদের নির্দেশেই একটি রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয়। বিশেষ বিশেষ আদর্শ ও পন্থা অবলম্বন করে তাঁরা দলের একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী ইমেজ দাঁড় করাতে সর্বদা কাজ করে যান। এই ইমেজ এবং আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে সৃষ্টি হয় হাজারো ভক্ত-সমর্থক। এই ভক্ত এবং সমর্থকরাই দলের প্রধান শক্তি হিসেবে দলের যে কোন প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সুপ্রীম পাওয়ার হিসেবে কাজ করেন এবং দলকে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছে দেন।

জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গ একটি দলের কঠিন সময়ে দলের হাল ধরেন এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দলকে টিকিয়ে রাখেন। নিজস্ব মেধা ও গুণাবলী দিয়ে তাঁরা দলের সমর্থকদের মাঝে একটি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা সৃষ্টি করেন। আর তাঁদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসে দলের মূল নেতৃত্ব বা সুপ্রীম লীডার।

সুপ্রীম লীডার হলেন জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি দলের অন্য তিন ধরণের ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে অর্থাৎ নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক, ইকোনমিক ডোনারস এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স বা সাহসী প্রকৃতির লোকজনের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন এবং সহায়তা আদায় করতে পারেন। ফলে তাঁর প্রভাব দলের অন্যসকল জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। যা তাঁকে সেই দলের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করে। তিনি হয়ে ওঠেন দলের প্রধান নেতা, প্রধান আস্থার জায়গা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।

অনেক সুপ্রীম লীডারের ইমেজ এত শক্তিশালী এবং সমর্থকসংখ্যা এত বেশি হয়ে থাকে যে, তাঁর মৃত্যু কিংবা অবর্তমানে তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে কোন একজনকে দলের মূল নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়। তবে, উত্তরাধিকারীর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুণে ঘাটতি থাকলে তিনি তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন না। ক্ষমতা দলের অন্য জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তির হাতে চলে যায়।

রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকবৃন্দ। নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকবৃন্দ মূলত দলের মূল নেতৃত্ব বা সুপ্রীম লীডারকেই অনুসরণ করে থাকেন। তবে, দলের অন্যান্য জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিববর্গকেও তারা কিছুটা অনুসরণ করেন। এই নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকগণ রাষ্ট্রীয় নির্বাচনে কিংবা দলের যে কোন প্রয়োজনে সুপ্রীম লীডারের ডাকে সুপ্রীম পাওয়ার হিসেবে কাজ করেন। সাধারণ সমর্থকদের অকুন্ঠ সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনই মূলত একটি রাজনৈতিক দলকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেয়। এ সকল নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক সৃষ্টি হয় প্রধানত তিনটি কারণে- সুপ্রিম লীডারের আদর্শ ও ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়ে, দলের সম্মিলিত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং দলের তৃণমূল নেতৃবৃন্দের সাথে সমর্থকদের যোগাযোগ ও আর্থ-সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে।

লিখিত অর্থে একটি রাজনৈতিক দল সরাসরি জনগণের টাকা মেরে খেতে পারে না, বা জনগণের পকেটের টাকা কেটে নিয়ে রাজনীতি করতে পারে না। যদিওবা ক্ষমতায় গেলে নানা পন্থায় অর্থ আয় করা যায়। তবে বৈধভাবে খরচের কথা ভাবলে, একটি দলের বিভিন্ন প্রয়োজনে যে টাকা দরকার হয়, তার সবটুকু দলের এক নম্বর সারিতে থাকা জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের হাতে থাকে না। দল পরিচালনা, কর্মসূচি পালন কিংবা নির্বাচনের সময় যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটি দেয় ব্যবসায়ী শ্রেণী বা ইকোনমিক ডোনাররা। রাজনৈতিক দলে ইকোনমিক ডোনারদের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। দল নির্বাচনে জয়ী হলে এই সকল ইকোনমিক ডোনাররা দলের নিকট হতে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করেন। অনেক সময় তাঁদের কারণে দলের সার্বিক ভাব-মূর্তি নষ্ট হতে দেখা যায়।

দলের চতুর্থ উপাদান হলো স্ট্রাইকিং ফোর্স বা সাহসী প্রকৃতির লোকজন। এই শ্রেণীর লোকদের সব সময় দরকার না হলেও, দলের দুঃসময় এবং নির্বাচনকালীন সময়ে বেশ দরকার হয়। রাজনীতির ময়দানে সবসময় সাধারণ সমর্থক দিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়না। ফলে, স্ট্রাইকিং ফোর্স বা সাহসী প্রকৃতির লোকজনের দরকার হয়। বিপক্ষ দলের অন্যায় এবং অসাধু কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূচনা করার জন্য হলেও রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রকৃতির লোকজনকে সাথে রাখে। তাই এরাও একটি রাজনৈতিক দলের অংশ। সাহসী প্রকৃতির লোকজন যেমন দলের দুঃসময়ে কিংবা চরম মুহূর্তে পাশে থাকেন, তেমনি এদের অনেকেই নানারূপ সন্ত্রাসী এবং অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ফলে তাঁদের কারণে অনেক সময় দলের সার্বিক ভাব-মূর্তি নষ্ট হয়।

একটি রাজনৈতিক দলের আলোচিত এই চারটি উপাদানের মধ্যে দুইটি উপাদান মৌলিক এবং দুইটি উপাদান গৌণ। জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গ এবং নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক- এই দুইটি উপাদান হলো মৌলিক উপাদান যাদেরকে বলা যেতে পারে একটি রাজনৈতিক দলের প্রাণ। অন্য দুইটি উপাদান- ইকোনমিক ডোনারস এবং সাহসী প্রকৃতির লোকজন একটি দলের জন্য প্রয়োজনীয়, তবে মৌলিক উপাদান নয়।

একটি রাজনৈতিক দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই দরকার হয় জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের। যারা তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও মানবিক গুণাবলি দিয়ে একটি দলের ভাল ইমেজ সৃষ্টি করেন এবং একটি বৃহৎ মানবগোষ্ঠীকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিববর্গকে অনুসরণ করেই সৃষ্টি হয় একটি দলের হাজারো সমর্থক। তাই, জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিববর্গকে একটি দলের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গের পরেই রয়েছেন নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকবৃন্দ। দলের যে কোন অন্তীম মুহূর্তে কিংবা নির্বাচনের সময় সুপ্রীম লীডারের ডাকে যদি নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকগণ এগিয়ে না আসেন, তাহলে কখনই একটি রাজনৈতিক দল তার ক্রান্তিকালে টিকে থাকতে পারে না কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধীষ্ঠিত হতে পারে না। নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকগণ দলের পাশে না থাকলে অন্য দুটি উপাদান অর্থাৎ ইকোনমিক ডোনারস এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স কোন কাজে আসে না। তাই, দ্বিতীয় মৌলিক উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয় নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকবৃন্দকে।

রাজনৈতিক দলের প্রথম দুইটি উপাদান ঠিক থাকলে পরের দুইটি উপাদান স্বয়ংক্রীয়ভাবে তৈরী হয়ে যায়। দল পরিচালনার জন্য টাকার দরকার আছে। তবে, শুধু টাকার উপর ভর করে রাজনীতি করা যায় না সবসময়। এছাড়া, ব্যবসায়ী ও ডোনাররা সব কিছুতেই রিটার্ন খোঁজেন এবং নিজ শ্রেণীর লোকজনের ভাগ্য উন্নয়নে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। তাই, শুধু টাকা আছে বলে এই শ্রেণীকে নেতৃত্বে বসানো উচিত নয়। তাঁদের কিছু কিছু ব্যবসায়িক বৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যেতে পারে, তবে ক্ষমতা নয়।

আবার, স্ট্রাইকিং ফোর্স বা সাহসী প্রকৃতির লোকজন দলের নানা বিপদে বা ক্রান্তিকালে কাজে আসলেও তাঁরা অনেক সময় নানারূপ জনবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে দলের ভাব-মূর্তি নষ্ট করেন। তাঁরা কোন প্রকার নেতৃত্বে আসলে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং অসামাজিক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেন। ফলে, সাধারণ নাগরিকগণ সামাজিক জীবনে নানা হয়রানির শিকার হন। তাই, এই শ্রেণীকেও নেতৃত্বে নিয়ে আসা উচিত নয়।

লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, Email: raihankawsardu@gmail.com

মতামতের জন্য লেখক দায়ী থাকিবেন।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj