অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
ফৌজদারি ন্যায়বিচারঃ(Principles of Criminal Justice )
ন্যায় বিচারের যে শাখায় সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী অন্যায় কার্যসমূহের শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা থাকে তাকে ফৌজদারি ন্যায় বিচার বলা হয়। ফৌজদারি মামলায় ফরিয়াদি আসামির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট দন্ডনীয় অপরাধ বা কতিপয় অপরাধমূলক কার্য করার অভিযোগ পেশ করে থাকে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, ফৌজদারি ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে আদালত আসামি বা অন্যায়কারী ও কথিত অপরাধীকে মূল বিবেচ্য বিষয় বলে বিবেচনা করে। আসামির অপরাধের প্রক…তি,গুরুত্ব ও মাত্রা নিরুপনের সময় আদালত যতদুর সম্ভব নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে এবং সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নির্দোষ বিবেচনা করবে। বর্তমান কালের সমাজ কল্যানের ব্যাপক ধারনার প্রভাবে এবং উহার মানবতার পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি দন্ডবিধির কঠোর ধারাগুলি যতদুর সম্ভŸ নমনীয় করা হচ্ছে। বহু দেশে মৃত্যু দন্ডাদেশ রহিত করা হয়েছে এবং অন্যান্য অপরাধের সাজার ক্ষেত্রে সংশোধনমূলক মনোভাব বেশী প্রাধান্য লাভ করেছে। কতকগুলি অন্যায় কার্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয়বিধ বিচারাদালতের নিকট বিচার্য বিষয় হিসেবে গ্রহনযোগ্য হতে পারে। মানহানি,কুৎসা,অবৈধ প্রবেশ,মিথ্যা মামলা রুজু প্রভৃতি অপরাধের জন্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি যে কোন আদালতের নিকট বিচার প্রার্থনা করা যেতে পারে।
ফৌজদারি ন্যায়বিচারের লক্ষ ও মূলনীতিসমূহঃ ( Purpose and Principles of Criminal Justice )
অপরাধি ব্যক্তির অপরাধ বিশ্লেষন করে ক…ত অন্যায় কাজের জন্য শাস্তি বিধান করায় ফৌজদারি ন্যায়বিচারের মূলনীতি অর্থাৎ ফৌজদারি ন্যায়বিচার পদ্ধতি দোষী ব্যক্তির অপরাধ বিশ্লেষন করে কৃত অন্যায় কাজের জন্য শাস্তি প্রদান করে থাকে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনই এর প্রধানতম উদ্দেশ্য। কোন ব্যক্তি সামাজিক বা আইনগত কর্তব্য পালনে অবহেলা করলে ফৌজদারি আদালত আইন লংঘনকারী ব্যক্তির প্রতি দন্ড বা শাস্তির বিধান দিয়ে থাকে। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা তথা অন্যায়-অপরাধ প্রতিরোধকল্পে আধুনিক রাস্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের উৎপত্তি,ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতি ঘটেছে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তথা নাগরিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার সুমহান উদ্দেশ্যে বিচার প্রশাসনকে ফৌজদারি ও দেওয়ানি এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। দেওয়ানী বিচার প্রশাসনের মাধ্যমে জনগনের অধিকার সংরক্ষিত হয়। পক্ষান্তরে সংশ্লিষ্ট অপরাধিকে তার কৃত অপরাধের জন্য যথাযথ শাস্তি প্রদানপূর্বক সামাজিক শান্তি সুসংহত করাই ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের উদ্দেশ্য। তবে ফৌজদারি আইনের দন্ডদানের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে যেগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয় সেগুলি সাধারনতঃ নিম্নরুপ
(১) শাস্তি প্রদানঃ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তথা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করায় ফৌজদারি ন্যায় বিচারের উদ্দেশ্য।
(২) অপরাধ সংঘটন কমানোঃ একইভাবে অপরাধমূলক ঘটনা যাতে না ঘটে বা হ্রাস পায়,সে উদ্দেশ্যেই অপরাধিকে শাস্তি দেয়া হয়। সুতরাং অপরাধ সংঘটন-হ্রাসকরনেও ফৌজদারি ন্যায় বিচার বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
(৩) সমাজ সংরক্ষণঃ অপরাধমূলক কার্যাবলি হতে সমাজের মানুষকে রক্ষা করা তথা সমাজ সংরক্ষনই ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
(৪) অপরাধ সংঘটনের বাধা প্রদানঃ সম্ভাব্য অপরাধিদের অপরাধমূলক কার্যাবলী হতে বাধা প্রদান করাও ফৌজদারি ন্যায়বিচারের অন্যতম উদ্দেশ্য।
(৫) প্রকৃত অপরাধিকে নিবৃত্ত করাঃ একইভাবে এরুপ বিচার প্রশাসন প্রকৃত অপরাধিকে ভবিষ্যত অপরাধমূলক কার্যাবলী সংঘটন করা হইতে নিবৃত্ত করে।
(৬) চরিত্র সংশোধনঃ ফৌজদারি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অপরাধিকে তার কৃত অপরাধের জন্য শাস্তি প্রদান করা হয় ফলে অপরাধির চরিত্র সংশোধন হয়।
(৭) সুনাগরিকে পরিনত করাঃ ফৌজদারি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অপরাধিকে সাজা প্রদান করা হয় ফলে সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে সে সুনাগরিক বা আইন অনুগত নাগরিক হিসেবে পরিনত হয়।
(৮) সমন্ময় সাধনঃ আইন বিজ্ঞানী প্যাটনের অভিমত অনুযায়ী “ফৌজদারী ন্যায়বিচারের লক্ষ্য হবে অন্যান্যকে আইন ভঙ্গকরা হতে সংযত রাখা এবং অপরাধির মনোভাব এবং সমাজ জীবনে প্রয়োজনের মধ্যে পুনরায় সমন্ময় সাধন করা”
(৯) শান্তি শৃঙ্খলা সুসংহত করাঃ সর্বোপরি রাস্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে অপরাধিকে শাস্তি প্রদান পূর্বক সামাজিক ও রাস্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা সুসংহত করায় ফৌজদারি ন্যায় বিচারের মূল নীতি ও লক্ষ্য ।
শাস্তির আধুনিক ও প্রগতিশীল বিকল্প হিসেবে ‘খালাসের পন্থা স্থগিত সাজা এবং ‘সংশোধাগারে প্রশিক্ষন’ এর কার্যকারিতার মূল্যায়নঃ
শাস্তি প্রদানের যেমন বিভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে তেমনি শাস্তি প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কেও বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ,সম্ভাব্য অপরাধিকে নিরোধ এবং সর্বোপরি অপরাধিকে সংশোধিত হবার সুযোগ প্রদান এ সকল বিষয়সমুহ শাস্তির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্চনীয়
উল্লেখ্য যে, শাস্তির আধুনিক ও প্রগতিশীল বিকল্প হিসাবে ‘খালাসের পন্থা, স্থগিত সাজা’ এবং ‘সংশোধাগারে প্রশিক্ষন’ এর কার্যকারিতা বিশেষভাবে ফলপ্রসু ও কার্যকর হতে পারে। কারন অপরাধ সংঘটনের জন্য অপরাধিকে সাজা দান করায় সাজার প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়। শাস্তি বা সাজা প্রদানের উদ্দেশ্য হল সমাজকে অপরাধমুক্ত করা তথা অপরাধি যাতে ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে জীবনযাপন করার জন্য সংশোধনাগারে প্রশিক্ষন পায় তার ব্যবস্থা করা এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ও কার্যকারী করার জন্য ‘খালাসের পন্থা, স্থগিত সাজা; এবং ‘সংশোধাগারে অপরাধির প্রশিক্ষন এর ব্যবস্থা করা বিশেষভাবে দরকার। সর্বোপরি নিবৃত্তমূলক, নিবারনমূলক ও প্রতিশোধমূলক দন্ডের পাশাপাশি সংস্কারমূলক বা সংশোধনমূলক দন্ডের ব্যবস্থা রাখা অপরিহার্য। বিভিন্নভাবে পরীক্ষ করে দেখা গিয়েছে যে, সংস্কারমূলক দন্ডদানের ফলে অপরাধির চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে এবং সে নিজেকে একজন স্বাবলম্বী ও সুস্থমানুষ হিসেবে বাঁচতে চায়। এরুপ দন্ড দানের মাধ্যমে সে একজন সৎ ও সুনাগরীক হিসেবে গড়ে উঠে এবং নিজেকে স্বাবলম্বী মনে করে।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী, E-mail: advmizanur98@gmail.com