রায়হান কাওসার
ছোট বেলায় গরমের দিনে দাদার সাথে বারান্দায় ঘুমাতাম। দাদার সাথে ঘুমাতে ভাল লাগত, কেননা দাদা পাখার বাতাস করতেন ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। দাদা বেঁচে ছিলেন অনেক দিন। ১০০ বছরের উপরে। বুড়ো বয়সেও দাদার ছিল বেজায় রাগ। কোন বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমাদের গাছের লেবু, আম, পেয়ারা কিংবা বরই চুরি করতে আসলে লাঠি নিয়ে দিতেন সেই তাড়ানি।
সেই দাদা আজ আর নেই। একদিন হঠাৎ করেই বড় ঘুম দিয়ে দিলেন। আর জাগলেন না। সবাই বলল, “এই ঘুমিয়ে পড়া অচেতন লোকটাকে আর দরকার নেই আমাদের। দূরে কবর খুঁড়ে রেখে আসা হোক। নইলে আমাদের ঘুম হারাম হবে।” কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তাড়াতাড়ি করে রেখে আসল সবাই দুরে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে মাটি খুঁড়ে। দাদা চলে যাবার পর বাড়ির বারান্দায় রাতে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো। মানুষ মারা গেলে নাকি তার আত্মা ৪০ দিন বাড়িতে এসে ঘুরাঘুরি করে। রাতে আলো জ্বালিয়ে রাখলে নাকি মৃত আত্মাদের বাড়িতে আসতে এবং বাড়িতে ঘুরাঘুরি করতে সুবিধা হয় অনেক।
ছোট বেলায় মরা মানুষের কথা শুনলে বেশ ভয় লাগত। এত চেনা দাদা! তার পরও তার কথা রাতে বললেই কেমন জানি গা ছম ছম করত। দাদা চলে যাওয়ার পর দাদির সাথে থাকতাম। ভাই বোনদের মধ্যে আমিই মনে হয় দাদা-দাদির কাছে বেশি প্রিয় ছিলাম। জোছনা রাতে বারান্দায় ঘুমাতে ভয় লাগত না। কিন্তু অন্ধকার রাতে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করত। ভয় লাগত তখন অনেক। সে সময় বিদ্যুৎ ছিল না। কেরোসিনের বাতিতে বা হারিকেনে পড়েছি আমরা কয়েক ভাই-বোন। সবাই যখন একসাথে পড়তে বসতাম, আমি নিজের পড়া না দেখে তাদের পড়া কৌতুহল ভরে দেখতাম। তারা দুপুরে অর্থাৎ ১২ টায় স্কুলে যেত, আমি যেতাম সকালে। সকালে স্কুলে যেতে ভাল লাগত না, ভাবতাম কবে যে বড় ক্লাসে পড়ব আর দুপুর বেলা স্কুলে যাব! ছোট বেলায় গল্প শুনতাম, রাতের বেলা নাকি মাঝে মাঝে ছেলেধরা আসে। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের পা ধরে টেনে নিয়ে চলে যায়। যদিও একটু ভয় লাগত তবুও গরমের রাতে বাইরে বারান্দায় ঘুমাতাম। কতরাতে যে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙেছে! মনে হতো কেউ জানি দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এই বুঝি পা ধরে টান মারবে।
গরমের দিনে দাদিও বাতাস করতেন তবে গল্প বলতে পারতেন না অতটা। আমার মা আবার ভাল গল্প বলতে পারতেন। মা এর কাছে গল্প শুনতে চাইলেই গল্প বলতেন মা। তবে দাদি সবচেয়ে ভাল ভর্তা বানাতে পারতেন। দাদির আলু ভর্তা বেগুন-ভর্তা যাই হোক না কেন, সেটা সবার চেয়ে ভাল হতো। সেই দাদা, সেই দাদি দুজনেই বিদায় নিয়েছেন এই মায়াময় পৃথিবী থেকে। ভাবলে কষ্টই লাগে, প্রাণ থেকে প্রাণের সৃষ্টি হয়। পুরনো প্রাণ বুড়ো হয়ে যায়। মারা যায়, মাটিতে মিশে যায়। হারিয়ে যায় কোথায় যেন। আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নবীন প্রাণগুলো শৈশব ও পূর্ণ বয়স পেরিয়ে তারাও একদিন প্রবীণ হয়। একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। মোহময় এই পৃথিবী থেকে সন্তান ও অনুজদের ছেড়ে চলে যায়। কে বা যেতে চায় এই আনন্দভুমি ছেড়ে, এই সুবুজে ভরা সুখে ভরা, প্রেমে ভরা পৃথিবী ছেড়ে! যেতেই হবে যে; মাফ নেই।
শুনতে যতই কষ্ট লাগুক, নির্মম মনে হোক না কেন। কেউ দুর্ঘটনায় মরছে, কেউ বুড়ো হয়ে মরছে, কেউ অসুখে পড়ে মরছে, কেউ অন্যের হাতে মারা পড়ছে, কেউ বা নির্যাতিত ও অবহেলিত হয়ে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। মরতেই হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা কতজন মানুষ সম্মান নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারছি? কেউ চোর-বাটপার উপাধি নিয়ে পৃথিবী ছাড়ছি, কেউ হীন ও বাজে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পৃথিবী ছাড়ছি। মৃত্যুর সময় আমাদের হৃদয় ছোটবেলায় যেমন ছিল, তেমন কি থাকে? নানা পাপ, অপরাধ ও ভুলের কারণে আমাদের হৃদয় কলুষিত হয়ে যায়। অতৃপ্ত ও ব্যথিত হৃদয় নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হয় আমাদের।
আমরা এই পৃথিবীতে কিছুদিন থাকছি, তারপর সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে লোকগুলো আপনার একেবারেই অচেনা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করে মাটি খুড়ে আপনাকে দূরে রেখে আসবে। কিছুই নিয়ে যাওয়া যাবে না। তার পরও আমরা নানা অন্যায় করি, দুর্নীতি করি। টাকার পাহাড় গড়ি, অন্যকে ঠকিয়ে সম্পদ হাতিয়ে নেই। অন্যকে বিপদে ফেলি। আমরা রাজনীতিবীদরা অনেক সময় নানা সুবিধা ও ক্ষমতা অর্জনের মোহে অন্ধ হয়ে যাই। ধরাকে সরা জ্ঞান করি। অন্যকে কিভাবে বিপদে ফেলা যায়, পরাজিত করা যায় সেটাই বসে বসে চিন্তা করি। ন্যায়-অন্যায় ভুলে যাই। কিন্তু আমরা তো একদিন চলে যাব পৃথিবী ছেড়ে। কেউই অনন্তকাল বেঁচে থাকব না। সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে এই মায়াময়-প্রতিযোগিতাময় পৃথিবী ছেড়ে।
করোনা মহামারির এই সংকট কালেও অনেকে রিলিফের চাল চুরি করছেন, তেল চুরি করছেন। মজুদদাররা জিনিস-পত্রের অতিরিক্ত দাম রাখছেন- যা অত্যন্ত অমানবিক ও অন্যায়। ক্ষনিকের দুনিয়ায় একটু ভাল থাকার জন্য আমরা অন্যকে আর হয়রান না করি, তাদের হক আর না মারি। এ পৃথিবী আপনার নয়, অন্যেরও নয়। সবাইকেই একদিন এ পৃথিবী গ্রাস করবে। দু’দিন আগে কিংবা দু’দিন পরে। সুতরাং…
লেখক: রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, Email: raihankawsardu@gmail.com