ফায়জুল্লাহ ফয়েজ
বাংলাদেশে আইনজীবীদের ব্যাপারে জনমনে একটা প্রচলিত ধারণা হচ্ছে আইনজীবীরা অসৎ, আইনজীবীরা মিথ্যাবাদী, যার নাই কোন গতি সে করে ওকালতি।
যদিও এসব ধারণা শতভাগ সত্য নয়, তবে যা রটে কিছু তো ঘটে।
আমার ধারনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ওকালতি করা অত্যন্ত সহজ এবং অনেক অযোগ্য লোকজন বাংলাদেশে আইনজীবী হিসেবে আছেন।
পৃথিবীর উন্নত দেশে কিন্তু আইনজীবী হওয়া এতো সহজ নয়, ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কথাই যদি ধরি তবে ওখানে আইন পেশার সনদ পাওয়া বাংলাদেশের এফসিপিএস ডাক্তার হবার চেয়েও কঠিন।
ইংল্যান্ডে আইনজীবী হতে হলে প্রথমে আইনে অনার্স বা ডিপ্লোমা করে বার প্রফেশনাল ট্রেইনিং কোর্স করে সেটা পাশ করতে হয়, তারপর সিনিয়র কোন ব্যারিস্টার যদি পিউপিল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং পিউপিল হিসেবে একবছর পার করতে পারেন তবেই কোর্টে শুনানি করার পার্মিশন পান।
এর আগে কিছু লাইসেন্স নিতে হয় , যেমন ইন্সুরেন্স করা প্রত্যেক সলিসিটর ও ব্যারিস্টার এর জন্য বাধ্যতামূলক, যদি কোন ব্যক্তি আইনজীবীর ভুলের কারনে মামলায় হারেন তবে সে আইনজীবীর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন এবং ইন্সুরেন্স কোম্পানী সেই ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা দেয়।
পেশাগত অদক্ষতা ও অসদাচরণের দায়ে প্রায় ই সলিসিটর বা ব্যারিস্টারদের সনদ স্থগিত হয়ে যায় বা জরিমানা গুনতে হয়।
অথচ কোন মক্কেল আইনজীবীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমন নজির মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে নাই।
২০১২ সালের আগে আইনজীবী হতে লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা ই যথেষ্ট ছিলো, ১৯৯৬ সালের আগে শুধু ভাইবা ই যথেষ্ট ছিলো, প্রফেশনাল ট্রেইনিং কোর্স বলতে কিছুই এদেশে নেই।
কয়েকবছর আগে বড় একজন আইনজীবীর কাছ থেকে ঘুরে আমাদের কাছে এসেছেন এক ক্লায়েন্ট একটি দেওয়ানি মামলা নিয়ে, মামলাটি অর্ডার ৭ , রুল ১১ এ খারিজ হয়ে গেছে কারন , আইনে বাধ্যতামূলক যে নোটিশ দিতে হবে আইনজীবী তা না দিয়েই মামলা করেছেন।
কিছুদিন আগে এক মামলা এসেছে স্পেসিফিক পারফরম্যান্স এর মামলা রিকোয়ার্ড মানি ডিপোজিট ছাড়াই করেছেন এবং মামলা খারিজ হয়েছে।
আজকে দেখলাম এক প্রিয়েম্পশন মামলা দায়ের করেছেন প্রয়োজনীয় ডিপোজিট ছাড়াই।
ভিটা বাড়ির প্রিয়েম্পশন চেয়েছেন SAT Act এর ৯৬ ধারায় এরকম মামলাও পেয়েছি।
চেকের মামলা টাইম পার হবার পর দায়ের করা হয়েছে, আর্জিতে কজ অফ একশন স্পষ্ট হয়নি এমন ঘটনা অহরহই।
প্রায় অর্ধেক রিট খারিজ হয়ে যায় অল্টারনেটিভ রিমেডি আছে তাই রিট মেইনটেইনবল না এই গ্রাউন্ডে।
যথাসময়ে কোর্টে না থাকায় মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা সচরাচর ই দেখা যায়, ক্যাপাসিটির অতিরিক্ত মামলা নিয়ে কোর্টে সঠিক সাবমিশন দিতে না পারা, তাড়াহুরা করে ভুল ড্রাফটিং এগুলো তো খুব কমন আমাদের আদালত গুলোতে।
অথচ মক্কেল আইনজীবীর এসব ভুলের জন্য কোন প্রতিকার পান না, কানন অফ প্রফেশনাল এথিক্স এন্ড কন্ডাক্টস নামে যেই আইনটি আছে সেখানে কিছু সততার বাণী থাকলেও আইনজীবীদের অদক্ষতার কারণে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোন প্রতিকার নেই।
নিজের অদক্ষতার কারণে মক্কেলের বিশাল ক্ষতি করেও আইনজীবী হিসেবে পেশা চালিয়ে যেতে পারছেন কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে, চাকুরী না পেয়ে দুবছর আইনের কোর্স করে নেমে পড়েছেন আইন পেশায়, মুহুরী গিরি করতে করতে হয়ে যাচ্ছেন আইনজীবী, শুনেছি কোর্টের পাশে চায়ের দোকানদারি করতে করতে একজন আইনজীবী হয়ে গেছেন, তবুও কি বলবো না এদেশে আইন পেশা সবচেয়ে সহজ।
এতো অন্ধকারে ও আলো আছে, বর্তমানে প্রচুর আইনজীবী আছেন ব্যারিস্টার, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া, সততার সর্বোচ্চ রূপ ও দেখা যায় অনেক আইনজীবীদের মধ্যে।
বহু আইনজীবী লড়াই করে যাচ্ছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নিজে থাকছেন শতভাগ সৎ, পড়াশোনার দিক দিয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড এর আইনজীবীদের চেয়ে ও অনেক ভালো, তবে এদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, বার কাউন্সিল যেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ, সেখানে এই সৎ, দক্ষ আইনজীবীরা কি পারবেন ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে?
লেখকঃ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ।