যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে সৃষ্ট মানবিক সংকটের জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তিনি বলেছেন, সীমান্ত সংকট আমেরিকার সবার জন্য এক মানবিক চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। ১৪ মার্চ এই সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মার্কিন অভিবাসন নিয়ে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। আর এই নৈরাজ্যের জন্য দায়ী ট্রাম্প।
পেলোসি বলেন, ট্রাম্পের বেপরোয়া নীতির জেরেই এখন অভিবাসনের প্রবাহ শুরু হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনকে এখন এই সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভেঙে পড়া সীমান্ত-ব্যবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সীমান্তে বানের জলের মতো নেমে আসা অভিবাসী, তাঁদের সঙ্গে থাকা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের সামাল দিতে অভিবাসন বিভাগ ও সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই এক লাখের বেশি মানুষ দক্ষিণের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁর অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সীমান্ত খুব ভালো অবস্থায় ছিল। সীমান্ত নিরাপদ ছিল। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সংরক্ষিত ছিল।
ডেমোক্রেটিক পার্টি বাধার সৃষ্টি না করলে সীমান্ত দেয়াল নির্মাণের কাজ অনেক আগেই শেষ করতে পারতেন বলে ট্রাম্প তাঁর বিবৃতিতে দাবি করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, সীমান্ত দিয়ে আসা নথিপত্রহীন অভিবাসীদের ধরে ছেড়ে দেওয়ার নিয়মের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় লাভের জন্য জালিয়াতিসহ আদম পাচার বন্ধ করতে পেরেছিলেন বলে দাবি করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, দক্ষিণের সীমান্তের ঘটনা আমেরিকাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই ভয়ংকর বিষয়টি তাঁকে দেখতে হচ্ছে। এ জন্য ট্রাম্প হতাশা প্রকাশ করেন।
জনপ্রবাহের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক শিশুকে নিরাপদে রাখার জন্য ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট (ফেমা) কর্মকর্তাদের দক্ষিণের সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হোমল্যান্ড সেক্রেটারি আলেজান্দ্রো মেওয়রকাস গত শনিবার ফেমা কর্মকর্তাদের সীমান্তে পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্দেশে ফেমা কর্মকর্তারা সীমান্তে আসা শিশুদের মানবিক আবাসনের ব্যবস্থা করবেন।
ট্রাম্পের সময় সীমান্ত দিয়ে আসা লোকজনের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। সেই পরিস্থিতিকে একটি মানবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য বাইডেন প্রশাসন প্রয়াস চালাচ্ছে বলে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।বিজ্ঞাপন
ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সীমান্ত দিয়ে আসা জনপ্রবাহের কারণে আশ্রয়প্রার্থীদের রাখার স্থাপনাগুলোতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কোথাও কোথাও ৭০০ শতাংশ বেশি লোকজনকে রাখতে হচ্ছে বলে খবর আসছে। রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে সীমান্তের এই পরিস্থিতিকে সংকটজনক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে ডেমোক্র্যাট নেতারা একে একটা চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার অভিবাসন ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে। প্রায় চার দশকেও কোনো অভিবাসন সংস্কার আইন প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে দেশটি। ব্যাপক অভিবাসনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আমেরিকায় অভিবাসন ব্যবস্থায় কঠোর নিয়মনীতি চালু করতে গিয়ে ট্রাম্প বেপরোয়া সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কখনো নির্বাহী আদেশ দিয়ে, কখনো অভিবাসন আইনের অলস ও কঠোর বিধানের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাকে বৈরী করে তোলেন তিনি।
২০ জানুয়ারি ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন অভিবাসন নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হন। কিন্তু তার আগে তাঁকে ট্রাম্পের সময়ের বৈরী অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লড়তে হচ্ছে। অভিবাসনের নানা বিষয়ে যেখানেই তিনি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, তাঁকে ট্রাম্পের সময়ে পাল্টে দেওয়া নিয়মনীতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ঢেলে সাজাতে হচ্ছে অভিবাসনের পুরো প্রক্রিয়াকে। সমন্বিত কোনো আইন প্রণয়নের আগে অভিবাসন প্রক্রিয়ার চলমান বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন বাইডেন।
বাইডেনের দক্ষিণ সীমান্তবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রোবার্টা জ্যাকবসন বলেছেন, চার বছরের আরোপিত নিয়মনীতি এক দিনেই পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। গত চার বছরে ; অভিবাসন ব্যবস্থাকে নাজুক করে তোলা হয়েছে। তার মধ্যে করোনা মহামারি পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জন্য কিছু সময় লাগবে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লুকাস গুটেন্ট্যাগ ‘ইমিগ্রেশন পলিসি ট্র্যাকিং’ নামের একটি প্রকল্প পরিচালনা করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় অভিবাসন নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেছেন, নতুন সব নিয়মনীতি নানাভাবে আরোপ করা হয়েছে। লোকবলের বিন্যাস ও প্রশিক্ষণ সেভাবেই দেওয়া হয়েছে। এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জটিল সব পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে বাইডেন প্রশাসনকে যেতে হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
অভিবাসন নিয়ে চরম বিভক্ত মার্কিন সমাজ। শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীরাই শুধু নয়, সমাজের অধিকাংশ লোকজনের মধ্যে অভিবাসন নিয়ে মিশ্র মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করেই বলেছেন, আমেরিকায় একটি মানবিক অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। এ কাজটি যে সহজ নয়, তা নতুন প্রশাসনের ১০০ দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এদিকে, অভিবাসনবিরোধীরা বসে নেই। তাঁরা চেনা প্রচারণা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, অভিবাসীদের ব্যাপক আগমনে আমেরিকার অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল লোকজনে ভরে উঠবে। অপরাধীদের আগমনে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হবে। স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের ওপর চাপ পড়বে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তাঁর প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদের আক্রমণের জন্য স্পর্শকাতর এই ইস্যুটিকে বেছে নিয়েছেন।