রায়হান কাওসার
ক্ষমতাই আইনের জনক। ক্ষমতাবানদের নিকট থেকেই আইন পৃথিবীর আলো দেখে। আইনের নিজস্ব হাত পা নেই। তার প্রকাশের জন্য তাকে কোন না কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছার উপরেই নির্ভর করতে হয়। যেহেতু ক্ষমতাই আইনকে জন্ম দেয়, সেহেতু ক্ষমতা ব্যবহারকারী লোককদের মধ্যে বিরাজমান ক্ষমতা-ভারসাম্য আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ক্ষমতার ভারসাম্যের মূলকথা হলো ক্ষমতা যেন কোন একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিকট পূঞ্জীভূত না হয়ে থাকে, সেটি যেন অন্তত দুটি রাজনৈতিক শক্তি শিবিরের মধ্য সমান কিংবা কাছাকাছি মাত্রায় বন্টিত থাকেযারা হবে কাছাকাছি ক্ষমতা সম্পন্ন এবং একে অন্যের যথেষ্ট ক্ষতি সাধনে সক্ষম। পৃথিবীতে সকল জীবই নিজ স্বার্থআগে বিবেচনা করে। মানুষ জীবদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও বিচার-বিবেচনা সম্পন্ন হলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারাও নিজ স্বার্থই আগে বিবেচনা করে। নিজ স্বার্থ আগে বিবেচনা করা মন্দ কিছু নয়, তবে নিজ স্বার্থ আগে বিবেচনা করতে গিয়ে একেবারে অন্ধ হয়ে অন্যের স্বার্থ বিনষ্ট করাও প্রত্যাশিত নয়। সুতরাং ক্ষমতা ব্যবহারের সময় রাজনৈতিক শক্তি শিবিরগুলো উভয় পক্ষের স্বার্থ বিবেচনা করেই আইন প্রণয়ন করবে- এটিই হলো ক্ষমতা ভারসাম্যের মূল কথা।
একটি দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকলে, সেদেশে একক গোষ্ঠীর পক্ষে আইন প্রণীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক সময়ই সেটি আপামর জনগণের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। উত্তর কোরিয়ার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সেদেশের প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা ও কথাই আইনের সমতুল্য। কেউ তাঁর ইচ্ছা কিংবা কথার বাইরে কাজ করলে তাকে তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া হয় এবং পদচ্যুত করা হয়। মিয়ানমারের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সে দেশে সামরিক জান্তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী; আলোচনা শেষে তাদের কথাই শেষ কথা। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের নীতি তাদের কাছে তেমন কোন নীতি নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ গুলো মানবাধিকার আইন ও নীতির বুলি আওড়ালেও সেই আইন আর নীতি তারা মানতে নারাজ।
গণচীনকে গণতান্ত্রিক দেশ বলা হলেও সেদেশে গণতন্ত্র রয়েছে প্রেসিডেন্ট এবং সেদেশের কিছুউচ্চ কর্তা ব্যক্তিদের নিকট। এখানকার জনগণ তাদের প্রেসিডেন্টকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারেনা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পর্যায়ক্রমে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন আছেনবিশ বছর ধরে; আরও কিছু দিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন বলে আশা করা যায়। আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে সেটি করেও নিচ্ছেন সময়মত। আবার, আফ্রিকার দরিদ্র-পীড়িত দেশগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, এখানকার জনগণ দরিদ্র পীড়িত হওয়ায় এখানে ক্ষমতার উৎস রয়েছে কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে।
ভালভাবে লক্ষ করলে বুঝা যায়, যে সকল দেশের রাজনীতিতে বিপক্ষ শক্তি-শিবির দুর্বল ক্ষমতাসম্পন্ন কিংবা নাগরিকরা কম শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, সে সকল দেশে একজন কিংবা মুষ্টিমেয় লোকের কথাইআইনে পরিণত হয়। কেননা, এ সকল দেশের বিপক্ষ শক্তি-শিবির এখনও সেভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি, তাই ক্ষমতার ভারসাম্যও তৈরী হয়নি। ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকায় অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী শিবির দুর্বল শিবিরের কথায় কোন কর্ণপাত করে না, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয় সবসময়। আইন বলতে ধরা-বাধা নির্ধারিত কোন নীতি থাকে না। প্রয়োজন পড়লে আইন পরিবর্তন করা হয় যেকোন সময়।
রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য দুই ধরনের হয়ে থাকে- জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। কোন কোন দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য অনেক সময় দেশীয় গন্ডির বাইরেও চলে যায়। জাতীয় রাজনীতির শক্তি বলয় দুটি সমান কিংবা কাছাকাছি শক্তি সম্পন্ন হলে দু’পক্ষের সংঘর্ষের সময় নিজস্ব শক্তির চেয়ে আরও বেশি শক্তিরপ্রয়োজন হলে, তারা আন্তর্জাতিক ক্ষমতা বলয়দের সাহায্য প্রার্থনা করে। অন্তর্জাতিক শক্তি বলয় দের সংঘর্ষ জাতি সমূহের জন্য অনেক ঝুকিপূর্ণ ও বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনার সম্ভাবনা থাকায় প্রাথমিকভাবে তারা পরোক্ষ ভাবেই দেশীয় পক্ষদ্বয়দের সহায়তা করার চেষ্টা করে। তবে কোন দেশীয় সমস্যা আন্তর্জাতিক শক্তি বলয় গুলির জন্য খুবই গুত্বপূর্ণহলে, তারা সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও পিছপা হয়না যা পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকবার দেখা গিয়েছে।
ক্ষমতা সবচেয়ে মূল্যবান এবং গৌরবের। সেটি চিরস্থায়ী ভাবে একজনের হাতে থাকে না; সময় সময় হাত বদল হয়। হাত বদল হয়ে যার হাতে যায়, আইন তাকেই অনুসরণ করে। এক সময় ইংল্যান্ডের রাজার হাতে অনেক ক্ষমতা ছিল, এখন নেই। সেটির হাত বদল হয়েছে। প্রভাব ও বিত্তশালী নাগরিকরা একজোট হয়ে রাজারপ্রকৃত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেটিকে সেদেশের পার্লামেন্টের হাতে প্রত্যর্পণ করেছে।
ইংল্যান্ডের মত আমেরিকাতেও একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। এদেশের নাগরিকরা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষিত ও বিত্তশালী হওয়ায় তাদের সম্মিলিত শক্তির প্রভাবে সেদেশে সীমিত সংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এদেশের নাগরিকরাই বেশি শক্তিশালী এবংতারা তাদের কর্তা ব্যক্তিদের নিজেরাই সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারে।
আইন ক্ষমতাকে অনুসরণ করবে- এটিই পৃথিবীর চিরায়ত রীতি; আগেও ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। এই ক্ষমতা যখন মুষ্টিমেয় লোকের হাতে থাকবে তখন মুষ্টিমেয় লোকের কথাই আইনে পরিণত হবে। এক্ষত্রে মুষ্টিমেয় লোকের নিকট পছন্দনীয় আইন সে দেশের বেশিরভাগ মানুষের উপর আরোপিত হবে। এতে করে অনেক সময় দেখা যাবে, অনেক আইনই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিকট পছন্দনীয় হবে না।
মানুষের জীবনে সুখ নির্ধারিত হয় দুটি উপাদানের ভিত্তিতেঃ (এক) অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং (খ) ব্যক্তি-স্বাধীনতা।একজন মানষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা রয়েছে কিন্তু তারটাকা-পয়সা যদি সে ইচ্ছেমত খরচ করতে না পারে কিংবা তাকে এমন কাজে নিয়োগ করা হয় যে কাজ সে ভালভাবে বুঝে না কিংবা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না, তখন তার স্বচ্ছলতা বা টাকা-পয়সাতাকে পরিপূর্ণ সুখ দিতে পারে না।
আবার, অনেক সময় আর্থিক স্বচ্ছলতা কম থাকলেও একজন মানুষ যেটি করতে চায় কিংবা তার মন যেটি করতে ভালবাসে- সেটি করতে পারলে তার অনেক ভাল লাগে, সুখ অনুভব করে, সুখী ভাবে নিজেকে। তাই, ব্যক্তি-স্বাধীনতাও মানুষের সুখ নির্ধারনের অন্যতম উপাদান।
একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন, তবে তার বাসায় খাবার নেই- সেটি যেমন সুখের ক্ষেত্রে অন্তরায়, আবার স্বচ্ছলতা আছে কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা নেই- সেটিও সুখ অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। সুতরাং, সামাজিক জীবনে সুখী হতে হলে একজন ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা- দুটি উপাদানেরই প্রয়োজন। যে কোন একটি হলে সুখ অর্জন সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রীয় জীবনে কার কতটুকু অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা দরকার সেটি নিরূপণ করা কঠিন। তবে এই দুটি উপাদানের পরিমাণ নির্ধারণে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বলয়দের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কাছাকাছি থাকলে সেটি দেশের নাগরিকদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখে। দুটি কাছাকাছি ক্ষমতাধর পক্ষ থাকলে উভয় পক্ষই একে অপরের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে আগ্রহী থাকে এবং আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের ইচ্ছা-অনীচ্ছা’র বিষয়টি মাথায় রাখে। কেননা, দুটি সম-ক্ষমতা সম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তি শিবিরের মধ্যকার দ্বন্দ্ব উভয় পক্ষের সুখ এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে যার মুখোমুখি কোন পক্ষই সহজে হতে চায় না। সে কারণেই রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য যে দেশে যত বেশী, সে দেশের অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা সম্পর্কিত আইন তত বেশি জন কল্যাণমূলক।
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। সাবেক শিক্ষার্থী আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। email: raihankawsardu@gmail.com