অগ্রক্রয়াধিকারমূলক অধিকার হলো কোনো ক্রেতার কাছ থেকে আবার ক্রয়ের অধিকার। শরিকের কোনো বিক্রীত জমি বহিরাগত ক্রেতার কাছ থেকে অপর কোনো শরিক কর্তৃক আদালতের মাধ্যমে মূল্য ও নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিয়ে ক্রয় করাকে pre-emption বা অগ্রক্রয় বলা হয়।
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫ এর ২৬ ধারা, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৯৬ ধারা এবং ১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৪ ধারায় এ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ১৮৮৫, ১৯৫০ এবং ১৯৪৯ সালের আইন তিনটির যথাক্রমে ২৬, ৯৬(১৭) ও ২৪(১০) ধারায় মুসলিম আইন দ্বারা অগ্রক্রয়ের অধিকার শুধু নিশ্চিত করা হয়নি বরং অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশে pre-emption কেবল সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিবেচনার বিষয় নয়; বরং আইন দ্বারা সংরক্ষিত অধিকার।
উল্লেখিত ২৬, ৯৬ এবং ২৪ ধারার বিধানের সঙ্গে মুসলিম আইনের মৌলিক পার্থক্য হলো, মুসলিম আইন অনুসারে অগ্রক্রয় করতে হলে আনুষ্ঠানিক দাবি অর্থাৎ মুসলিম আইনের ২৩৬ ধারা মোতাবেক বিক্রয়ের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে অভিপ্রায় বা ‘তলব-ই-মৌসিবত’ ঘোষণা করতে হয়। তলব-ই-মৌসিবত এভাবে পেশ করা চলে, “আমি আমার শুফার হক দাবি করছি (হেদায়া, ৫৫১)”। সাক্ষীর সামনে দাবি করাকে বলে ‘তলব-ই-ইশাদ’। মূল্য ও ক্ষতিপূরণের টাকা মামলায় ডিক্রি হওয়ার আগে আদালতে জমা দিতে হয় না।
পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ এবং অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক দাবি উপস্থাপন করতে হয় না। তবে মামলা দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গে (along with the petition for pre-emption) বিক্রীত দলিলে উল্লেখিত জমির মূল্যসহ ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
কখন অগ্রক্রয়ের অধিকার জন্মায়:
যখন কেউ সহ-অংশীদার বা শরিক (Co-sharer) ছাড়া তৃতীয় কারো কাছে সম্পূর্ন বৈধ ও ত্রুটিমুক্তভাবে জমি বিক্রি সম্পন্ন করে বিক্রিসংক্রান্ত নোটিশ জারি (Sale notice) করে, তখন অন্য বা অন্যান্য অংশীদার ওই বিক্রির নোটিশ পাওয়ার বা বিক্রির খবর বা তথ্য জানার তারিখ থেকে অগ্রক্রয়ের অধিকার জন্মায়।
অগ্রক্রয়ের আবেদন আদালতে পেশ করার সময়সীমা:
বিক্রিসংক্রান্ত নোটিশ জারি কিংবা দলিল পূর্ণাঙ্গভাবে রেজিস্ট্রি অথবা বিক্রয় বিষয় জানার দুই মাসের মধ্যে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, The State Acquisiton & Tenancy Act, 1950 কার্যকর হয় ১৯৫১ সালের ১৬ মে এবং ওই তারিখ থেকে Bengal Tenancy Act বাতিল হয়। (The new S.A.T Act has repealed the famous Bengal Tenancy Act, l885) এর দীর্ঘদিন পর ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে আলোচ্য ৯৬ ধারার ১৮ উপধারার মধ্যে ১২টিতে সংশোধনী আনা হয়। সেই সংশোধনী অনুযায়ী প্রতিকার প্রার্থনা বা মামলা করার সময়সীমা চার মাস থেকে দুই মাস করা হয়। ৯৬(১)(বি) ধারা অনুযায়ী কোনো অবস্থায় তিন (তিন) বছরের পর মামলা করা যাবে না।
সময়সীমা ৪ মাস, অতঃপর কমিয়ে দুই মাস, আবার তিন বছরের মধ্যে প্রতিকার প্রার্থনার বিষয়টি কারো কারো কাছে ঘোলাটে বা পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে সংশোধনীর আগে দলিল নিবন্ধন হওয়ার বা জ্ঞাত হওয়ার চার মাসের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা ছিল। এই জ্ঞাত হওয়ার বিষয়টি ব্যাপক ও বিস্তৃত। অর্থাৎ কেউ যদি ১২ বছর পর বিক্রির বিষয় জ্ঞাত হয়, তাহলে ওই জানা থেকে চার মাসের মধ্যে অর্থাৎ দলিলের বিষয় জানার বারো বছর+চার মাস (১২ বছর ৪ মাস) সময় পেতেন। ২০০৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী ওই ব্যাপক ও বিস্তৃত সময়সীমার একটি রেখা টানা হয়েছে। ফলে যিনি যখনই বিক্রি বিষয় জানুক, কোনো অবস্থায় তিন বছর পর অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না।
কে কে এ অধিকার প্রয়োগ করতে পারে:
১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী নিম্নের ব্যক্তিবর্গ pre-emption right প্রয়োগ করতে পারে-
ক. বিক্রীত জমির ওয়ারিশ সূত্রে শরিক।
খ. বিক্রীত জমির খরিদ সূত্রে শরিক।
গ. স্থানান্তরিত জমিসংলগ্ন জমির স্বত্বাধিকারী প্রজা।
ওই আইনের ৯৬ ধারা মোতাবেক অগ্রক্রয়ের অধিকার আদায়ে মামলা করতে পারতেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী (Contiguous) প্রজাদের অগ্রক্রয়ের সুযোগ থাকায় হাজার হাজার মামলার উদ্ভব হয়। মামলার এ সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় নিয়ে ২০০৬ সালের ৩৪ নম্বর আইন দ্বারা ওই ৯৬ ধারার ১২টি উপধারা সংশোধন করতঃ বিক্রীত জমিসংলগ্ন স্বত্বাধিকারীকে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারবে না। এ বিধান করা হয়েছে। ফলে সর্বশেষ অর্থাৎ ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুধু ওপরে বর্ণিত (ক) ও (খ) দফার শরিকরা এ অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
ভূমিসংলগ্ন প্রজার অগ্রক্রয়ের অধিকার আর নেই। মুসলিম আইনের ২৩১ ধারা অনুযায়ী নিম্নলিখিত তিন শ্রেণীর ব্যক্তি অগ্রক্রয়ের দাবি করতে পারে-
১. সমপত্তির সহ-অংশীদার [শাফি-ই-শরিক]
২. খালাস বা অনুবন্ধের অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি, যেমন কোনো সড়ক ব্যবহারের অথবা পানি নিষ্কাশনের অধিকারসমপন্ন ব্যক্তি [শাফি-ই-খালিত]; এবং
৩. সংলগ্ন স্থাবর সমপত্তির মালিক [শাফি-ই-জার]; তবে, তাদের ভাড়াটিয়ারা নয়। অথবা কোনো সমপত্তির বে-আইনি দখলদার ব্যক্তিও নয়। [বেঈলি, ৪৮১]।
কোনো ওয়াকিফ অথবা মোতোয়ালির অগ্রক্রয়ের অধিকার নেই, কারণ ওয়াকফ সমপত্তির মালিকানা তাহার কাছে বর্তায় না।
তবে বিক্রেতার জমি ও শাফির জমির মধ্যে সরকারি জমি থাকলে সংলগ্নতা থাকবে না।
অগ্রক্রয়ের মামলা করার নিয়ম:
অগ্রক্রয়ের অধিকার আদায়ের জন্য ওপরে বর্ণিত ব্যক্তিরা ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ ধারা মতে-
ক. হস্তান্তরের বিষয় জানার বা দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার দুই মাসের মধ্যে মামলা দায়ের,
খ. মামলার আবেদনের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের ২৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ জমা দিতে হবে,
গ. এ ছাড়া বিক্রয় মূল্যের ওপর বার্ষিক ৮ শতাংশ সরল সুদ জমা দিতে হবে।
১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী-
১) অগ্রক্রয়ের দরখাস্তের সঙ্গে বিক্রীত মূল্যে ওপর ৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ জমা দিতে হয়,
২) অগ্রক্রয়ের দরখাস্ত জমা দেওয়ার সময়সীমা এক মাস,
৩) ক্রেতা, প্রতিপক্ষ খরিদের পর জমির উৎকর্ষ সাধনের কোনো অর্থ ব্যয় করলে তার ওপর শতকরা সোয়া ছয় টাকা হারে সুদ দেওয়ার বিধান আছে।
ওপরের শর্তগুলোর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে pre-emption এর দরখাস্ত অগ্রাহ্য হবে। এত কিছুর পরও ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ এবং ১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৪ ধারা বিধান অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের মামলা চলে না, যদি-
১. বিক্রীত জমি বসতবাড়ি হয়।
২. অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করার আগে বিক্রীত জমি বিক্রেতার কাছে হস্তান্তরিত হয়।
৩. উক্ত বিক্রয় যোগসাজশী (Collusive) বা জাল (Fraudulent) বিবেচিত হয়।
৪. বিনিময় বা ভাগবাটোয়ারাসংক্রান্ত সম্পত্তি হস্তান্তর হয়।
৫. স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীর বরাবরে উইল বা দানমূলে সম্পত্তি হস্তান্তর করে।
৬. হেবা-বিল-এওয়াজ মূলে হস্তান্তর করলে।
৭. রক্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তিন পুরুষের কোনো দান বা উইল মূলে হস্তান্তর করে।
৮. মুসলিম আইনে ওয়াক্ফ এবং ধর্মীয় কারণে বা দাতব্য উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত হস্তান্তরে।
কোন আদালতে যাবেন:
যে আদালতের ‘Suit for recovery of possession’ বা দখল পুনরুদ্ধারের মামলা গ্রহণের এখতিয়ার আছে শুধু সেই আদালত ‘application for pre-emption’ গ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ যে জমি নিয়ে pre-emption বা অগ্রক্রয়ের মামলা করা হয়েছে সেই জমি নিয়ে কোনো দখল উদ্ধারের মামলা দায়ের করলে যে আদালতে দায়ের করতে হয় pre-emption মামলাটিকে সেই আদলতে দায়ের করতে হবে। আরো সোজা কথায় বলতে গেলে দলিলের মূল্যমান অনুযায়ী এখতিয়ারবান অর্থাৎ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সহকারী জজ, দুই লাখের ঊর্ধ্বে কিন্তু অনূর্ধ্ব চার লাখ পর্যন্ত সিনিয়র সহকারী জজ এবং তদূর্ধ্ব সব পরিমাণ মূল্যমানের জন্য যুগ্ম সহকারী জেলা জজ আদালতে এ মামলা করা যাবে (জজদের নতুন আর্থিক এখতিয়ার কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত)।
আপিলের বিধান:
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ৯৬(১২) ধারা অনুযায়ী আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে একবার আপিল করা যাবে। কিন্তু ওই আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আর দ্বিতীয় আপিল করা যাবে না। তবে প্রথম আপিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১১৫ ধারা অনুযায়ী Revision দায়ের করা যায়।
লেখক: রাসেল সিদ্দিকী
চেয়ারম্যান, বিএলএলএসএ