অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
জমি-জমার মূল্য বর্তমানে অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর সূত্রে আমাদের দেশে একই জমি ৭/৮ বার বিক্রয় করার ঘটনা অহরহই ঘটছে।অর্থাৎ একই জমিকে ভিন্ন ভিন্ন দলিলে কয়েকবার বিক্রয় করা হচ্ছে। কোন কোন সময় ভিন্ন লোককে বিক্রেতা সাজিয়ে ভূয়া দলিল রেজিস্ট্রি করছে। সীমাহীন জালিয়াতির মাধ্যমে বিরামহীনভাবে চলছে দেশব্যাপী এমন প্রতারনা ও জোচ্চরী কর্মকান্ড।দেশে যে রেজিস্ট্রেশন ও ভূমি আইন প্রচলিত রয়েছে তার ফাঁক ফোকর গলেই এক শ্রেনীর ধূর্তরা এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে।
এমনকি মিথ্যা ও ভূয়া দলিলের মাধ্যমে সরকারের খাস জমিকেও তারা অবলিলায় বিক্রয় করে দিচ্ছে। আইনের ফাঁক ফোকর ও দুর্বলতার সুযোগে টাউট বাটপাররা একদিকে যেমন ভূমির ক্রেতাকে ঠকাচ্ছে,তেমনি বিক্রেতাকেও। একদিকে জাল দলিল মারফত দায়বদ্ধ ও কন্টকাকীর্ণ জমিকে তারা নির্দায়ী ও নিষ্কন্টক বানিয়ে ফেলছে,তেমনি কতিপয় ক্ষেত্রে নির্দায়ী ও নিষ্কন্টক ভূমিকে তারা কন্টকাকীর্ণ করে তুলছে।
তাই জমি কেনার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরী। ভেজাল জমি কিনে একদিকে যেমন সারা জীবনের সঞ্চয় হারাতে হয়,তেমনি পুত্র পৌত্রাদী ওয়ারিশানক্রমে সকলকে কোর্ট কাচারি,মামলা মোকদ্দমার সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেয়া হয়। ১৯০৮ সালের যে আইনের ভিত্তিতে আমাদের দেশে এখনো জমি কেনা বেচা চলছে সে আইনের ফাঁক ফোকরে জালিয়াতির সংখ্যাও বাড়ছে সীমাহীন গতিতে। ভূমির মালিকানা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন ব্যাপার বটে। অজ্ঞ লোকজন মুন্সি-মোহরী ও দালালের শরনাপন্ন কিংবা খপ্পরে পড়ে ভূমি ক্রয় করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ করেছেন- এমন উদাহরন ভুরিভুরি। পরিণামে তাদের আমছালা দুটোই গেছে।
অনেক শিক্ষিত লোকজনকেও দেখা গেছে ভাল করে কাগজপত্র যাচাই বাছাই না করে জমি ক্রয় করে মহা বিপদে পড়েছেন। ক্রয়ের পর জমিতে বাড়ি করতে গিয়ে জানতে পারলেন ঐ জমি ব্যাংকের নিকট বন্ধকী অবস্থায় আছে। এছাড়া এমন ঘটনাও ঘটেছে, জমির কাগজপত্র সব ঠিক,মালিকানা স্বত্বও ঠিক, কিন্তু জমির পজিশন বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যটা। অর্থাৎ অন্য দাগের জমিকে সেই দাগের জমি বলে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আইনগত ফাঁক ফোকর তো আছেই। এজন্য জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে হবে।
১। যার কাছ থেকে জমি কিনবেন তার থেকে ঐ জমি সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্রের ফটোকপি চেয়ে নিন। যেমন সি.এস খতিয়ান,এস.এ খতিয়ান, আর.এস খতিয়ান, বি.এস খতিয়ানসহ আজ পর্যন্ত যত কেনাবেচা হয়েছে সেগুলোর বায়া দলিল,মিউটেশনকৃত খতিয়ান এবং হাল সালের খাজনা দাখিলাসহ সংশ্লিস্ট সকল কাগজপত্র।
২।এরপর উল্লেখিত কাগজপত্রগুলো একজন ভাল সিভিল ল‘ইয়ার(আইনজীবী)কে দিয়ে জমিটির টাইটেল টেষ্ট করিয়ে নিন। বিজ্ঞ আইনজীবী যেভাবে টাইটেল টেষ্ট করবেন তা হলো-তিনি সি.এস খতিয়ান ও এস.এ খতিয়ান পাশাপাশি মিলিয়ে দেখবেন জেলা,মৌজা,থানা দাগ নম্বর ইত্যাদি মেলে কিনা। যদি না মেলে তাহলে জানতে হবে কেন মিললো না। যেখানে সি.এস খতিয়ান ভেঙ্গে এস.এ দাগ হয়েছে সেখানে না মিলবারই কথা। অতএব ঐ মৌজার সি.এস সীট এবং এস.এ সীট জোগাড় করে এরপর সি.এস সীটের উপরে এস.এ সীট বসিয়ে দেখতে হবে সি.এস ভেঙ্গে কয়টা দাগ হয়েছে এবং সেগুলি কি কি।
এরপর ভূমি রেকর্ডরুম থেকে ঐ খতিয়ানগুলোর সইমোহরী নিয়ে মালিক বা রায়তের নাম কনফার্ম হতে হবে। যদি সি.এস খতিয়ানের দখলকারেরর নামের সহিত এস.এ খতিয়ানের রায়তের নাম না মিললে যেতে হবে সি.এস এর মালিক জমিটি কি করলেন। তিনি যদি বিক্রয় করেন,দান,হেবা,এওয়াজ বা কোনরুপ হস্তান্তর করে থাকেন তাহলে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তল্লাশী দিতে হবে এবং হস্তান্তর দলিলের সইমোহরী নকল বের করতে হবে। আর যদি সি.এস খতিয়ানের মালিক জমিটি হস্তান্তর না করে থাকেন,তাহলে তার বংশ তালিকা নিয়ে ফারায়েজ অনুযায়ী দেখতে হবে বিক্রেতার অংশ বা হিস্যা কতটুকু। তিনি ফারায়েজ অনুযায়ী যতটুকু জমির প্রাপক বা মালিক,ততটুকু জমি কেনাই নিরাপদ হবে।
৩। বিক্রেতার জমিটি তার অন্যান্য শরীকদের সঙ্গে বন্টননামা হয়েছে কি না তা দেখতে হবে। বিক্রেতা যদি বলেন যে, আপসমূলে বন্টন হয়েছে কিন্তু রেজিস্ট্রি হয়নি ,তাহলে ফারায়েজ অনুযায়ী বিক্রেতা যেটুকু হিস্যার দাবিদার তার চাইতে একচুল বেশী কেনাও নিরাপদ হবে না। ফারায়েজ ও হিস্যা বন্টন খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। দলিলে ফারায়েজ/হিস্যার পূর্নাঙ্গ বর্ণনা থাকতে হবে।
৪। জমি বিক্রেতার মালিকানা স্বত্ব তথা বিক্রয়ের বৈধ অধিকার আছে কি না তা দেখতে হবে অর্থাৎ জমির মালিক নাবালক কিংবা অপ্রকৃতস্থ বা পাগল কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে। নাবালক বা পাগল হলে আদালতের মাধ্যমে গার্ডিয়ান নিযুক্ত করে জমি বিক্রয়ের অনুমতি নিতে হবে।
৫।অংশীদার ব্যতীত অন্য কারও কাছ থেকে জমি নিলে আইনের বিধান মতে সকল অংশীদারকে নোটিশ দিতে হবে। অন্যথায় প্রিয়েমশন বা অগ্রক্রয়ের মামলা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
৬।বিক্রেতা যদি তার ক্রয় কৃত জমি বিক্রয় করতে চান ,তাহলে রেকর্ডীয় মালিক থেকে পরবর্তীতে হস্তান্তরিত সকল বায়া দলিল সমুহে বর্ণিত স্বত্ব ঠিক ছিল কি না তা দেখতে হবে। ঐ দলিলে বর্ণিত খতিয়ান ও দাগ নম্বর অনুযায়ী খতিয়ানসমুহ বের করে তা-ও বিশ্লেষন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিস/খতিয়ান অফিস/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন(রাজস্ব) অফিস থেকে সই মোহরী নকল নিয়ে তা যাচাই করতে হবে।
৭। আরও খতিয়ে দেখতে হবে জমিটি খাস,পরিত্যাক্ত কিংবা শত্রু সম্পত্তি কি না। অথবা সরকার কোন কারনে সম্পত্তিটি অধিগ্রহন করেছে কি না। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে Non- Encumbrance Certificate(N.E.C) নিতে হবে। এতে ঐ জমির সর্বশেষ মালিকের নাম থাকবে ।বিক্রেতাই যদি মালিক হনে তাহলে অসুবিধা নাই।
৮। এরপর দেখতে হবে বিক্রেতা ঐ জমির ব্যাপারে কাউকে Power of attorney দিয়েছেন কি না। এছাড়া ব্যাংক কিংবা অন্যকোন প্রতিষ্ঠানে মর্গেজ দিয়েছেন কি না-এটাও রেজিস্ট্রি অফিসে তল্লাশি দিযে জানতে হবে।
৯। জমিটির টাইটেল টেস্ট ok হওয়ার পরও কিন্তু কাজ থেকে যায়। এবার আরএস/বিএস সীট নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখতে হবে সীট অনুযায়ী ঐ জমিটিই সেই দাগের জমি কি না। নাকি দালালেরা অন্য দাগের জমি ক্রেতাকে দখল দিতে যাচ্ছেন।
১০। বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমিটি বর্তমানে কে দখলে আছে,ক্রয় করলে কোন কারনে ভোগ দখলে বাধাগ্রস্ত হবে কি না কিংবা রাস্তা বা পথাধিকারে কোন বাধা নিষেধ আছে কি না তা-ও সরেজমিনে যাচাই করে নিতে হবে।
সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়ার পরও খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে ঐ জমি নিয়ে কোন মামলা মোকদ্দমা আছে কি না। সম্ভব হলে পত্রিকায় লিগ্যাল নোটিশ দেয়া যেতে পারে। লিগ্যাল নোটিশের কয়েকটি ফটোকপি ঐ এলাকার দর্শনীয় স্থানে টাঙ্গিয়ে রাখা যেতে পারে যদিও সচেতনতা ছাড়া এ সংক্রান্ত লিগ্যাল নোটিশের আইনগত কোন ভ্যালু নেই।
দলিল রেজিস্ট্রি করার আগে সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া গেলে এরপর দলিল প্রস্তুত করতে হবে। দলিল লেখার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত আবশ্যক। অনভিজ্ঞ মুন্সি মোহরী দিয়ে দলিল না লিখিয়ে একজন ভাল মানের লইয়ার (আইনজীবী) এর শরনাপন্ন হওয়া উচিৎ। কেননা ভূমি সংক্রান্ত আইনগত দিকগুলো তিনিই ভাল বুঝবেন। ভূমি আইন,হেবা আইন ও রেজিস্ট্রেশন আইন সম্পর্কে অজ্ঞ লোক দিয়ে দলিল লেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। দলিল লেখা ও রেজিস্ট্রির বিষয়কে কেবল মুন্সি মোহরীর কাজ বিবেচনা করার কোন হেতু নেই।দলিলকে এত হালকাভাবে নেয়া আদৌ উচিৎ নয়। কেননা এতে দলিল গ্রহিতার সারা জীবনের সঞ্চয় জড়িত। আর দলিল গ্রহিতার উচিত বিষয়টির দিকে যথাযথ নজর দেয়া।
পুনশ্চঃ কোন জমি বায়না করার পূর্বে বিক্রেতার নিকট থেকে সমস্ত কাগজপত্রের ফটোকপি চেয়ে নিন। এরপর তা নিয়ে যে কোন সিভিল আইনজীবীর শরনাপন্ন হলে তিনিই প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন। এছাড়াও আপনি নিজ দায়িত্বে ভূমি অফিসে গিয়ে ঐ জমির নামজারি হতে কোন সমস্যা আছে কি না তা সংশ্লিষ্ট অফিসার এর নিকট থেকে জেনে নিতে পারবেন।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও আইনজীবী, জজকোর্ট মেহেরপুর mizanmpur06@gmail.com মোবাইলঃ ০১৭১৯-৪৭৭ ৫৫২