“ঢাকতে গতর কাপড় চাই
— সস্তা কিংবা দামী,
অন্যেরটা তো চাই না কভু
আমারটা চাই আমি।”
অর্থাৎ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া থাকে। যেগুলোকে এক কথায় বলা হয় মৌলিক অধিকার। প্রতিটি দেশের সংবিধানেই মৌলিক অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। আর সংবিধানে উল্লিখিত অধিকারগুলোই একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। মৌলিক অধিকার হলো আইনিভাবে স্বীকৃত অধিকার। তবে অনেকেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতিকে মৌলিক অধিকার বলে থাকলেও এগুলো হচ্ছে কেবল জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ। মৌলিক অধিকার নয়।
মূলত সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা প্রয়োগযোগ্য। আমাদের এই অধিকারগুলো প্রয়োগের চেষ্টা করার শতভাগ অধিকার রয়েছে। এটিকে সংবিধানের অধিকারের অধিকার বলা হয়। এটি নিজেই একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার অন্যান্য অধিকারকে কার্যকর করে তোলে।
এটা সম্ভব যে কখনও কখনও আমাদের অধিকারগুলো সহকর্মী, বেসরকারি সংস্থা বা সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লঙ্ঘিত হতে পারে। আর আমাদের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে আমরা আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে পারি। যদি এটি মৌলিক অধিকার হয় তবে আমরা সরাসরি কোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কাছে যেতে পারি।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট মৌলিক অধিকার প্রয়োগের জন্য নির্দেশনা, আদেশ বা রিট জারি করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং লঙ্ঘনকারীদের শাস্তিও দিতে পারেন।
এবার আমরা যদি একটু বৈশ্বিক বিবেচনায় যাই তাহলে বুঝতে পারবো মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব কতখানি। যেমনঃ
১৯৪৮ সালের Universal Declaration of Human Rights (UDHR)-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, “সকল মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং কোনো বৈষম্য ব্যতিরেকে প্রত্যেকেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” উক্ত ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, কাউকে খেয়াল খুশিমত গ্রেফতার বা আটক করা যাবে না এবং নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য শুনানীর মাধ্যমে উপযুক্ত আদালত কর্তৃক বিচার পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির থাকবে।
যা হোক, এবার মূল আলোচনায় আসা যাক।বাংলাদেশের সংবিধানে তৃতীয় ভাগে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে। সংবিধানে এ অধ্যায়ের শুরুতেই ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা বাতিল হয়ে যাবে।”
সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকার আছেঃ
অনুচ্ছেদ ২৭ঃ আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং আইনের আশ্রয় লাভঃ আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিক সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার আছে। কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
অনুচ্ছেদ ২৮ ও ২৯ঃবৈষম্য করা যাবে না এবং সমান সুযোগ: ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ এবং পদ লাভের ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ থাকবে এবং বৈষম্য করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৩১ঃআইনের আশ্রয় লাভের অধিকারঃ
সকল নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করেছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনী প্রক্রিয়া ব্যতীত কোনো নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটানো যাবে না। অর্থাৎ পুলিশ চাইলেই যে কাউকে তুলে নিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করতে পারবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইনী প্রক্রিয়া শুরু না করে কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারবে না।
অনুচ্ছেদ ৩২ঃজীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার: যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো নাগরিকের ব্যক্তি ও জীবনের স্বাধীনতা হরণ করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৩৩ঃগ্রেপ্তার ও আটকে রক্ষাকবচ: কোনো কারণে কাউকে আটক করা হলে, সেটির কারণ জানিয়ে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোনো অবস্থায় কাউকে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় হাজতে রাখা যাবে না। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পার্শ্ববর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আটক ব্যক্তিকে হাজির করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
অনুচ্ছেদ ৩৪ঃজবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ: ফৌজদারি অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়া কাউকে জোর-জবরদস্তি করে কোনো কাজ করানো যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৩৫ঃবিচার ও দণ্ড: এর মাধ্যমে ফৌজদারি অপরাধের বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে যদি কোন কাজ অপরাধের পর্যায়ে না পড়ে তাহলে পরবর্তীতে নতুন আইন করে সেই কাজকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। একে আমরা ইংরেজিতে বলি “Retrospective Effect”, এই নিয়ম পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে। একই অনুচ্ছেদের ২ নং উপ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে একই অপরাধের জন্য একাধিকবার অভিযোগের মাধ্যমে বিচার ও দণ্ড দেয়া যাবে না। অর্থাৎ কোন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির একবারই বিচার হবে। এই অনুচ্ছেদের ৪ নং উপ-অনুচ্ছেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ- এতে বলা হয়েছে, কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। অর্থাৎ কোনোভাবেই নিষ্ঠুর বা অমানবিক দণ্ড দেওয়া যাবে না।
অনুচ্ছেদ ৩৬ঃচলাফেরার স্বাধীনতা: দেশের যেকোনো স্থানে অবাধ চলাফেরা, বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং দেশত্যাগের পর পুনঃপ্রবেশের স্বাধীনতা রয়েছে নাগরিকদের। তবে এ স্বাধীনতা হবে জনস্বার্থে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে।
অনুচ্ছেদ ৩৭ ও ৩৮ঃসমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা: যেকোনো সমাবেশ বা সংগঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার স্বার্থ আইন দ্বারা বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে অধিকার ভোগ করতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ ৩৯ঃচিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা থাকবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও একটি মৌলিক অধিকার।
অনুচ্ছেদ ৪০ ও ৪১ঃপেশা ও ধর্মের স্বাধীনতা: যেকোনো নাগরিক আইন দ্বারা বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে যেকোনো কাজকে নিজের পেশা হিসেবে বাছাই করতে পারবেন। আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে।
অনুচ্ছেদ ৪২ঃসম্পত্তির অধিকার: আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিক সম্পত্তি অর্জন, ধারণও হস্তান্তর করতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ ৪৩ঃগৃহ ও যোগাযোগের অধিকার: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে। চিঠিপত্র ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেঃ
যদি কোনো কারণে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করার অধিকার রয়েছে।
এবার আসি রিট নিয়ে মূল আলোচনায়। আগেই বলেছি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ মহামান্য হাইকোর্ট-কে কতিপয় ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপের ক্ষমতা দিয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের এই এখতিয়ারকে রিট জারীর এখতিয়ার বলে। অর্থাৎ রিট শুধু মাত্র হাইকোর্ট বিভাগ জারী করতে পারে। কারো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন এবং হাইকোর্ট বিভাগ ১০২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য কতিপয় আদেশ নির্দেশ জারী করতে পারেন, ইহাকেই রিট বলা হয়।
রিট ৫ প্রকারঃ
♦বন্দী প্রদর্শন রিট,
♦পরমাদেশ বা হুকুমজারি রিট,
♦নিষেধাজ্ঞামূলক রিট,
♦উৎপ্রেষণ রিট ও
♦কারণ দর্শাও রিট ।
আলোচনার সুবিধার্থে এখানে রিট এর অনুচ্ছেদটি হুবহু তুলে দেয়া হল-
“অনুচ্ছেদ ১০২(১)-কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যে কোনো একটি বলবৎ করিবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সম্পর্কিত কোনো দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিসহ যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলী বা আদেশাবলী দান করিতে পারিবেন।”
(২) হাইকোর্ট বিভাগের নিকট যদি সন্তোষজনক ভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের দ্বারা অন্য কোনো সমফলপ্রদ বিধান করা হয় নাই, তাহা হইলে
(ক) কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে-
(অ) প্রজাতন্ত্র বা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিষয়াবলীর সহিত সংশ্লিষ্ট যে কোনো দায়িত্ব পালনে রত ব্যক্তিকে আইনের দ্বারা অনুমোদিত নয়, এমন কোনো কার্য করা হইতে বিরত রাখিবার জন্য কিংবা আইনের দ্বারা তাঁহার করণীয় কার্য করিবার জন্য নির্দেশ প্রদান করিয়া, অথবা
(আ) প্রজাতন্ত্র বা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিষয়াবলীর সহিত সংশ্লিষ্ট যে কোন দায়িত্ব পালনে রত ব্যক্তির কৃত কোনো কার্য বা গৃহীত কোনো কার্যধারা আইন সংগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে করা হইয়াছে বা গৃহীত হইয়াছে ও তাঁহার কোনো আইনগত কার্যকারীতা নাই বলিয়া ঘোষণা করিয়া উক্ত বিভাগ আদেশ দান করিতে পারিবেন; অথবা
(খ) যে কোনো ব্যক্তির আবেদনক্রমে- (অ) আইন সংগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে বা বেআইনী উপায়ে কোনো ব্যক্তিকে প্রহরায় আটক রাখা হয় নাই বলিয়া যাহাতে উক্ত বিভাগের নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইতে পারে, সেইজন্য প্রহরায় আটক উক্ত ব্যক্তিকে উক্ত বিভাগের সম্মুখে আনয়নের নির্দেশ প্রদান করিয়া, অথবা
(আ) কোনো সরকারি পদে আসীন বা আসীন বলিয়া বিবেচিত কোনো ব্যক্তিকে তিনি কোন্ কর্তৃত্ববলে অনুরূপ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠানের দাবী করিতেছেন, তাহা প্রদর্শনের নির্দেশ প্রদান করিয়া উক্ত বিভাগ আদেশ দান করিতে পারিবেন।”
উপরের অনুচ্ছেদটির ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়- হাইকোর্ট বিভাগ এমন কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেন যেখানে অন্য কোনো আইনের মাধ্যমে কোনো প্রকার প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী,কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার আইনী প্রতিকার লাভের জন্য সর্বনিম্ন এখতিয়ারাধীন আদালতে অভিযোগ দায়ের করবেন। যদি তিনি নিম্ন আদালতসমূহের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হন তবে তিনি উপরের আদালতে যাবেন।
অতএব দেখা যায়, সাধারণত হাইকোর্ট অভিযোগ দায়ের করার জন্য প্রাথমিক আদালত নয়। তবে কিছু কিছু বিষয়ে হাইকোর্ট প্রাথমিক বা বিশেষ অধিক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেন। তেমনই একটি অধিক্ষেত্র হল এই রিট।
অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(অ) অনুসারে, কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে হাইকোর্ট, প্রজাতন্ত্র বা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিষয়াবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোন দায়িত্ব পালনে রত ব্যক্তিকে আইনের দ্বারা অনুমোদিত নয়, এমন কোনো কার্য করা হতে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন। এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আইন বহির্ভূত কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য আদেশ দেয়া হয়।
পক্ষান্তরে, এই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশ আইনের দ্বারা তাঁর করণীয় কার্য করবার জন্য নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী নির্দেশনার সহাবস্থান রয়েছে এই অনুচ্ছেদে যা দুটি স্পষ্ট ক্ষেত্র নির্দেশ করে যাতে হাইকোর্ট তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন।
উদাহারণ স্বরূপ ধরা যাক- আপনি গ্রামে থাকেন, সেখানে সরকার নতুন রাস্তা বানাতে চান। সেজন্য জমি অধিগ্রহণ করা দরকার। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মূল কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি কমিশনার। তিনি প্রত্যাশী সংস্থার কাছ থেকে অনুরোধ পাওয়ার পর ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে তাদেরকে ভূমি অধিগ্রহণ আইনের ৩ ধারা মোতাবেক নোটিশ প্রদান করবেন। সেই নোটিশ পাওয়ার পর যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে তা শুনবেন এবং সেসব আপত্তি নিষ্পত্তি করে তিনি উক্ত আইনের ৭ ধারায় ক্ষতিপূরণ গ্রহণের জন্য নোটিশ প্রদান করে ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। দেখা গেল- আপনি ৩ ধারার নোটিশ পাননি। যেসব প্রক্রিয়ায় নোটিশ জারি করার কথা আইনে বলা হয়েছে তা মোটেও অনুসরণ করা হয়নি। আপনি সরাসরি ৭ ধারার নোটিশ পেলেন। এটি নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট আইনের লঙ্ঘন। এখন বোঝা দরকার এতে কোন মৌলিক আইনটি ভঙ্গ হয়েছে? এক্ষেত্রে প্রধানত ভূমি অধিগ্রহণ আইন এবং সেই সাথে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৪২ নং অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে, যা ১০২(২)(ক)(অ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
এর পরে আছে, অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(আ), যাতে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র বা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিষয়াবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো দায়িত্ব পালনে
রত ব্যক্তির কৃত কোনো কার্য বা গৃহীত কোনো কার্যধারা আইনসংগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে করা হয়েছে বা গৃহীত হয়েছে ও তাঁর কোনো আইনগত কার্যকরতা নাই বলে ঘোষণা করে হাইকোর্ট আদেশ দিতে পারবেন। এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে, প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারীর আইন বহির্ভূত কাজের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১০২(২)(খ)(অ) অনুসারে, যে কোনো ব্যক্তির আবেদনক্রমে হাইকোর্ট বিভাগ যদি মনে করে কোনো ব্যক্তিকে আইনসংগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে বা বেআইনী উপায়ে প্রহরায় আটক রাখা হয়েছে, সেক্ষেত্রে প্রহরায় আটক উক্ত ব্যক্তিকে উক্ত বিভাগের সম্মুখে আনয়নের নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন। এটি সাধারণত বেআইনী আটকাদেশের বিরুদ্ধে নাগরিকের রক্ষাকবচ।
অনুচ্ছেদ ১০২(২)(খ)(আ)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে হাইকোর্ট বিভাগ, কোনো সরকারি পদে আসীন বা আসীন বলে বিবেচিত কোন ব্যক্তিকে তিনি কোন্ কর্তৃত্ববলে অনুরূপ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত আছেন বলে দাবী করছেন, তা প্রদর্শনের নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন।
উপরের আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় বেশ স্পষ্ট, অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক)(অ)-(আ) এর অধীনে আবেদন করতে গেলে কোনো ব্যক্তির নিজের সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু অনুচ্ছেদ ১০২(২)(খ)(অ)-(আ) এর অধীনে যে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টের নিকট আবেদন করতে পারবেন।
এছাড়া, আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করে বোঝা দরকার তা হলো- কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে রিট মামলা চলে না। প্রতিপক্ষ হতে হবে রাষ্ট্র কিংবা তাঁর কোনো অঙ্গে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী।
আমাদের সংবিধান মূলত ব্রিটেন, ভারত ও মালয়েশিয়ার সংবিধানের আদলে রচনা করা হয়েছে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি কতটা সঠিক বা কার্যকর সে প্রশ্ন ভিন্ন, কিন্তু এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহের যথাযথ সংরক্ষণ হচ্ছে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। যেহেতু ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে তাই, কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান যদি আপনার মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে তাহলে, আপনি রিট মামলা দায়ের করতে পারবেন না।
তখন আপনাকে যেতে হবে, দেওয়ানী আদালতে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুণ- আপনি একটি প্রাইভেট মেডিকেলে ডাক্তার হিসেবে কর্মরত আছেন। আপনি ৫ বছর সুনামের সাথে কাজ করার পর, ম্যানেজমেন্ট যদি কোনো কারণে আপনার উপর ক্ষিপ্ত হন, তাহলে কোনো প্রকার কারণ প্রদর্শন ছাড়াই আপনাকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনার মনে হতেই পারে, এটি যদি সরকারি মেডিকেলে হয় তাহলে কি হবে? সহজ উত্তর তিনি রিট করার সুযোগ পাবেন, যার ফলাফল মোটামুটিভাবে দ্রুত।
প্রকৃতপক্ষে রিট মামলার মাধ্যমে কার্যকর সমাধান পাওয়ার তালিকা এদেশে কম দীর্ঘ নয়। মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করতে হয় “মাজদার হোসেন” মামলার কথা, যার মাধ্যমে আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, তাছাড়াও সম্প্রতি এমন অসংখ্য মামলার নজির আছে যার মাধ্যমে দেশে অনেক সমস্যার যুগান্তকারী সমাধান পাওয়া গেছে।
ছোট্ট করে একটু বলে নেয়া দরকার- আদালতের কোনো অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ যদি কেউ ভঙ্গ করেন তাহলে কি হবে? এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার জন্য নতুন করে একটি মামলা হয় আদেশ/নির্দেশ ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে, তাতে আদালত মামলার বিষয়বস্তুর আলোকে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক আদেশ দিতে পারেন। এসব মামলার ক্ষেত্রে প্রচলিত সমাধান হচ্ছে ভুল স্বীকার করে শর্তহীন ক্ষমা চাওয়া। অভিযোগের কোনো একটি বিষয়ে যদি আপনি আপত্তি করেন তবে সেই মামলা উভয়পক্ষের শুনানির মাধ্যমে নিস্পত্তি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমোক্ত সমাধানই বেছে নিতে দেখা যায়।
রিট বিষয়টি অনেক বিস্তৃত একটি আইনী বিধান। এত স্বল্প পরিসরে এর পূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ পাঠক কিছুটা ধারণা অন্তত এই লেখার মাধ্যমে পেতে পারেন, যা আরও জানার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই,মৌলিক অধিকার মানবাধিকারের উৎকর্ষক। এ অধিকার সংবিধান কর্তৃক বিধৃত, স্বীকৃত ও সংবিধানই তা রক্ষা করেন।
মৌলিক অধিকার অলঙ্ঘনীয় ও সরকার মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেন না। কিন্তু জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার স্থগিত হতে পারে।কোনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন রিট পিটিশন দায়ের এর মাধ্যমে। তখন আদালত তার মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে সরকারকে আদেশ দিতে পারেন। তাই বলা যায়,মৌলিক অধিকার মানুষের জীবন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক।
আয়েশা সিদ্দিকা লোপা।
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।