বরিশাল ব্যুরোঃ বরিশালের উজিরপুর উপজেলার পশ্চিম সাতলা গ্রামের অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত মায়ের দোয়া ক্লিনিকের ভুয়া এম বি বি এস ডাক্তার মোঃ রেজাউল করিমকে এক নারীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগে বুধবার সন্ধ্যায় (২০ আগষ্ট) গ্রেফতার করেছে উজিরপুর থানা পুলিশ৷
থানা পুলিশ ও নির্যাতিত নারীর মামলার এজাহারে জানাগেছে গত ১১ আগষ্ট দুপুরে মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার সুতারকান্দি গ্রামের মোঃ রহিম বেপারীর স্ত্রী মায়া বেগম (৪০) মুখে ও গলায় ইনফেকশন নিয়ে মায়ের দোয়া ক্লিনিকে ভর্তি হয়। ১৩ আগষ্ট অসুস্থ্য মায়া বেগমকে সেবা শুশ্রূষা করার জন্য তার ছোট বোন মোসাম্মৎ বিউটি আক্তার (২৫) ওই ক্লিনিকে আসলে সুচতুর লম্পট রেজাউল করিম বেস কৌশলে বিউটি আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে তার নাম্বারটি নিয়ে নেয় এবং ওই দিন রাত সারে ১২ টায় ফোন করে বিউটিকে ওই ক্লিনিকের ছাদে যেতে বলে৷ পরের দিন ১৪ আগষ্ট একই ভাবে গভির রাতে রেজাউল বিউটিকে ফোন করে ক্লিনিকের দোতলায় একটি রুমে ডাকে৷
লম্পট রেজাউলের ডাকে বিউটি আক্তার সারা না দিলে পরেরদিন ১৫ আগষ্ট দিনের বিভিন্ন সময় রেজাউল খুব কৌশলে বিউটিকে ভয় ভীতি দেখাতে থাকে। তাতেও কোনো কাজ না হলে ১৫ আগষ্ট রাত দেড়টায় ( ওয়ার্ডের সকল রোগীরা ঘুমিয়ে পরলে) অন্ধকার ওযার্ডের ভিতর ঢুকে ঘুমন্ত বিউটি আক্তারকে লম্পট রেজাউল করিম তার শরিরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়। ঘুমঘোরে বিউটি হঠাৎ ভয় পেয়ে জেগে উঠে চিৎকার চেচামেচি করলে রেজাউল দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ক্লিনিকের ছাদে গিয়ে আবার বিউটিকে ফোন করে তাকে ছাদে ডাকে৷ এই সময় বিউটি তার মোবাইল ফোনে লম্পট রেজাউলের সকল কথা রেকর্ড করেন। পরের দিন ১৬ আগষ্ট সকালে রেজাউল বুঝতে পারে যে বিউটি ও তার বোন রোগী মায়া বেগম শক্ত ও সাহসী মনের অধিকারী। এটা বুঝে রেজাউল বেস কৌশলে মায়া ও বিউটিকে তার ক্লিনিকে ২০ আগষ্ট সকাল পর্যন্ত আটক রাখে। এক রকম নজর বন্দি করে আটক রাখে। পরে মায়া বেগমের এক আত্মিয় ২০ আগষ্ট বুধবার সকালে বিষয়টি জানতে পেরে উজিরপুর থানায় হাজির হয়ে থানা পুলিশের সহযোগীতায় ওইদিন সন্ধ্যায় ওই ক্লিনিকে ভর্তি রোগী মায়া বেগম ও বিউটি আক্তারকে উদ্ধার করে এবং রেজাউলকে আটক করে থানায় নিয়ে এসে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ ( সংশোধিত / ২০০৩) এর ১০ ধারায় মামলা দায়ের করেন৷ মামলা নং ২৫।
ঘটনার আলোকে আরো জানা যায় বানরীপাড়ার ইলুহার গ্রামের দিন মজুর ফোরকান মিয়া তার ছয় বছরের শিশুপূত্র হাসানের পায়ুপথে সমস্যা দেখা দিলে সে হাসানকে নিয়ে রেজাউলের কাছে ডাক্তার দেখাতে গেলে অদক্ষ রেজাউল শিশু হাসানের পায়ুপথে কাটাছেরা করে সারাজিবনের জন্য হাসানের পায়ুপথ নষ্ঠ করে ফেলে এবং হাসান যখন মৃত্যুপথযাত্রী, রেজাউল তখন তার দিনমজুর বাবা ফোরকান মিয়ার থেকে ১৮ হাজার টাকা নিয়ে ভয়ভিতি দেখিয়ে ক্লিনিক থেকে তারিয়ে দেয়৷ পরে বিগত ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই ফোরকান মিয়া বাদী হয়ে ভুয়া ডাক্তার রেজাউলের নামে বরিশালের বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে সি আর ১৯৩/১৯ নং মামলা দায়ের করেন, মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।
পশ্চিম সাতলা গ্রামের দিন মজুর মৃত আদম আলী সরদারের ছোট ছেলে মোঃ রেজাউল ২০০৩ সালে আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ( এস এস সি) পাস করে, এরপরে সে বিলের শাপলা সালুক তুলে বিক্রি করে জিবিকা নির্বাহ করতো। হঠাৎ করে সে নিজেকে গায়েবি ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ডাক্তার সাজতে থাকে। এরপরে সে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ০৪-০-১১-১৬৫-০২৩ নম্বরের ষ্টুডেন্ট আইডির সিরিয়াল নম্বর থেকে নিজ নামে একটি এইচ এস সি পাসের সনদপত্র বের করে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইড খুঁজে ওই ষ্টুডেন্ট আইডি নম্বরটি মানিকগঞ্জের মোতিলাল ডিগ্রী কলেজের একজন ছাত্র মোহাম্মদ মোসারেফ হোসাইনের নামে পাওয়া যায়৷ সুতরাং স্পষ্টতই বোঝা যায় যে রেজাউলের এইচ এস সি পাসের সনদপত্রটি জাল বা ভুয়া। এরপরে সে নিজেকে এম বি বিএস ডাক্তার হিসাবে জাহির করে এবং পিচ ব্লেন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এম বি বি এস পাসের সনদপত্র সংগ্রহ করে। ওই সনদ পত্রগুলো পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তালিকায় পিচব্লেন্ড ইউনিভার্সিটির কোনো নাম নেই এবং দেশের একমাত্র আইনগত সংস্থ্যা বি এম ডি সিরও কোনো অনুমোদন নেই। এতে সষ্টতই বোঝা যায় তার এম বি বি এস পাসের সনদ গুলোও জাল জালিয়াতি করে অবৈধ উপায় সৃষ্ট বা অর্জিত। এ সকল ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার পশ্চিম সিমান্ত ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার পূর্ব সিমান্ত একদম অজ পাড়া গাঁ শাপলা সালুক আর সবজি উৎপাদনের বিল হিসাবে খ্যাত পশ্চিম সাতলা গ্রামে ভন্ড লম্পট রেজাউল নিজেকে মহা এম বি বি এস ডাক্তার সাজিয়ে সেখানে গড়ে তুলেছে এক আলিসান দ্বিতল ভবন। যেখানে তৈরী করেছে সে মানুষ মারার টর্চার সেল, যার নাম দিয়েছে ” মায়ের দোয়া ক্লিনিক ও ডিজিটাল ডায়াগষ্টিক সেন্টার”। এই ক্লিনিকে সে রোগীদের থেকে জোর করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার জন্য একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী বাহিনীও লালন পালন করে। এই সন্ত্রাসি বাহিনীর প্রধান হিসাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে রেজাউলের বড় ভাই মোঃ রুহুল আমিন। সে নিজেকে সব জায়গায় ওলামা লীগের সভাপতি হিসাবে পরিচয় দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয়। এ ছারাও সন্ত্রাসী বাহিনীকে দুজন সাবেক স্থানিয় সরকারের সদস্যরাও পৃষ্ঠপোষকতা করে বলে জানা গেছে৷
অন্যদিকে এই নরপশু ভুয়া ডাক্তার রেজাউলের বিরুদ্ধে হয়রানির স্বীকার হওয়া শত শত মানুষের অভিযোগ রয়েছে, যা দেশের বিভিন্ন তদন্ত সংস্থ্যা নিবির ভাবে তদন্ত করলেই থলের বিরাল বেরিয়ে আসবে। সাতলা এলাকার লোকজন ইতিমধ্যে সম্প্রতি ঢাকায় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের থেকেও রেজাউলকে ভয়ংকর হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে রেজাউল তার ক্লিনিকে বরিশাল ২ আসনে যে যখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তখন সেই সাংসদের সাথে ছবি তুলে তা ওই ক্লিনিকের সামনের ফটোকে লাগিয়ে রেখে নিজেকে এম পির খুব কাছের লোক হিসাবে জাহির করেন। বর্তমানে বরিশাল ২ আসনের সাংসদ মোঃ সাহে আলমের সাথে ছবি তুলে টানিয়ে রেখেছে। তার আগে সাবেক সাংসদ এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস ও তার আগের সাবেক সাংসদ মোঃ মনিরুল ইসলাম মনি”র সাথে ছবি তুলে টানিয়ে রেখেছিলো।
ভুয়া ডাক্তার রেজউলকে আটক ও ভিকটিমকে উদ্ধারের পুরো ঘটনাটি মনিটরিং করেন বরিশালের সহকারী পুলিশ সুপার উজিরপুর সার্কেল আবু জাফর মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ । এ বিষয়ে উজিরপুর মডেল থানাও ওসি মোঃ জিয়াউল হাসান বলেছেন মোঃ রেজাউলের নামে প্রায় অর্ধশত অভিযোগের খবর পাওয়া গেছে। সকল অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশের তদন্ত অব্যাহত থাকবে।