বঙ্গবন্ধুর পলাতক পাঁচ খুনিকে ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার৷ তবে এদের মধ্যে তিন জন পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করায় দেখা দিয়েছে জটিলতা৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে বলতে গিয়ে গণমাধ্যমকে এমন তথ্য জানালেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দীর্ঘদিন তিনি খুনিদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন৷
ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের পাঁচ জন এখনও পলাতক৷ এর মধ্যে দুই জনের নিশ্চিত অবস্থান সরকারের কাছে রয়েছে। অপর তিনজন পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন৷ পাকিস্তান তাদের শেল্টার দিচ্ছে৷ ফলে সরকার তাদের অবস্থান জানলেও বলতে পারছে না৷ ফেরানোর কোনো উদ্যোগও নিতে পারছে না৷’
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলও তাদের অবস্থান জানে। ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এন এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন এটা মোটামুটি সবাই জানেন৷ অপর তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন এখন কোথায় সেটা অনেকেই জানে না। আমি এদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এরা তিনজনই পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন৷ এর মধ্যে ডালিম কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে আছেন৷ আর রশিদ ও মোসলেমউদ্দিন আছেন লিবিয়ার বেনগাজিতে৷ গাদ্দাফি জীবিত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এই খুনিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন৷ এরা দুজন পাকিস্তান-বেনগাজি নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন৷’’
মোসলেমউদ্দিন নিয়ে ধোঁয়াশা
চার মাস আগে ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মোসলেমউদ্দিন ভারতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন৷ কিন্তু ভারতীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তরফে এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি৷
ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা অফিসের প্রধান (এনসিবি) ও পুলিশের সহকারী উপ-মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বলেন, ‘‘গণমাধ্যমেই আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনি মোসলেহউদ্দিনের গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানতে পারি৷ এরপর আমরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভারতীয় এনসিবির কাছে চিঠি দিয়েছিলাম৷ কিন্তু গত চার মাসেও আমরা ওই চিঠির কোনো জবাব পাইনি৷ এমনকি কিছুদিন আগেও আমরা তাগাদা দিয়ে আরেকটি চিঠি দিয়েছি৷ কিন্তু সে চিঠিরও কোন জবাব পাইনি৷ ফলে আমরা নিশ্চিত নই আসলে মোসলেমউদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা৷’’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, মোসলেমউদ্দিন গ্রেপ্তার হয়নি৷’’ ওয়ালিউর রহমানও বলছেন, ‘‘মোসলেমউদ্দিন ভারতে থাকার কোনো তথ্য তার কাছেও নেই৷’’
যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদকে ফেরানোর সম্ভাবনা বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্রে এ এম রাশেদ চৌধুরীর অবস্থানের বিষয়টি সরকার আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল৷ তাকে ফেরাতে নানা ধরনের চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে৷ গত জুনে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের মামলার নথি তলব করেন৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের চেষ্টার এক ধরনের অগ্রগতি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা৷ কারণ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মহলের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে মামলা পুনরায় সচল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার গত ১৭ জুন ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডের কাছে একটি চিঠি পাঠান৷ ওই চিঠিতে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী সংক্রান্ত নথি পাঠাতে ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডকে নির্দেশ দেন৷ গত ২৫ জুন রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবী দলের এক সদস্য এবং ১ জুলাই সম্ভাব্য আইন বিশেষজ্ঞের পক্ষে অন্য এক ইমিগ্রেশন আইনজীবী সময় বাড়াতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে অনুরোধ করেন৷ তাদের ওই অনুরোধের পর মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নথি উপস্থাপনের চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেন৷ এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদি সরকার৷
কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরাতে আইনী পদক্ষেপ
কানাডায় অবস্থান করা নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সরকার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নিয়েছে৷ কারণ, ব্যক্তিগত আইন সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নূর চৌধুরীর সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশকে তথ্য জানাতে সবসময় অপারগতার কথা জানিয়ে আসছিল কানাডা৷ এ পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনির তথ্য না দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য কানাডার কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ৷
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরে বিচারক জেমস ও’রেইলি মামলার রায়ে নূর চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে কানাডার সরকারকে অনুরোধ জানান৷ তবে এখন পর্যন্ত নূর চৌধুরীর ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয়নি দেশটি৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কানাডায় তো আইন রয়েছে যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজার বিধান আছে সেখানে তারা কাউকে ফেরত পাঠায় না৷ আমরা তাকে ফেরত আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷ নূর চৌধুরীকে ফেরানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা মামলাও দায়ের করেছি৷ আমরা সেখানকার জবাবের অপেক্ষায় আছি৷
১২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনের কার্যকর
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের রায় হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর৷ তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন৷ পরে উচ্চ আদালত ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন৷ ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ আরেক খুনি আজিজ পাশা ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান৷
পলাতক খুনিদের মধ্যে আবদুল মাজেদকে গত ৬ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ৷ এরপর ১১ এপ্রিল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়৷
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মাজেদ নাম ও পরিচয় গোপন করে ভারতের কলকাতায় ২৪ বছর ধরে বসবাস করছিলেন৷
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা হয়েছে৷ শনিবার সকালে রাজধানীর বনানীতে ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এ কথা জানান।
সূত্র : ডয়চে ভেলে