সাজিদ মাহমুদ ভুইয়া
ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারে আমার একজন প্রিয় স্যার বলেছিলেন তোমার হাত পা ছোড়ার স্বাধীনতা সেখানেই শেষ যেখান থেকে আর একজনের নাক শুরু হয়েছে। স্যারের এই কথা সেদিন স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতা উপভোগ করার ক্ষেত্রে কিছু লিমিটেশন রয়েছে। আর সম্ভবত এই জন্যই সংবিধানের যে অংশে মৌলিক অধিকারের কথা আলোচনা করা হয়েছে সেখানে Subject to reasonable restriction যোগ করা হয়েছে। অর্থাৎ কিছু বিধি নিষেধ সাপেক্ষে আমার অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তবে স্যারের সেই কথার সাথে আমি শতভাগ একমত পোষণ করতে পারছি না। নাহ, মুখের বা শারীরিক শক্তি দিয়ে বলছি না, বলছি আইনের শক্তিতে। আর এই ক্ষমতা বা শক্তি আমাকে দিয়েছে দণ্ডবিধি। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৯৬ নং ধারা ধারাতে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগজনিত কোন কাজই অপরাধ নয়। ধারা ৯৭ আরও সুস্পষ্ট করে দিয়েছে ব্যক্তিগত অধিকারের বিষয়টি। এই ধারা তে বলা হয়েছে দেহ এবং সম্পত্তির ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা। প্রত্যেক ব্যক্তির ধারা ৯৯ এর বিধিনিষেধ সাপেক্ষে আত্মরক্ষা বা প্রতিরক্ষার জন্য প্রথমে তার শরীর বা অন্য কারো শরীর রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত অধিকার রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত তার বা অন্য কারো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষার অধিকার রয়েছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি তার আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে সে বিষয়ে ধারা ১০০ ও ১০৩ এ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ধারা ১০০ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি নিম্নলিখিত ৬ টি ক্ষেত্রে তার বা অন্যর দেহ রক্ষার্থে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
Ø এমন ধরনের আক্রমণ যার ফলে ন্যায়সঙ্গতভাবে আশঙ্কা থাকে যে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে না পারলে সে আঘাতে মৃত্যু অনিবার্য।
Ø আক্রমণের ধরন এমন যে প্রতিরোধ না করলে গুরুতর জখম অনিবার্য।
Ø ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আঘাত বা আক্রমণ।
Ø অস্বাভাবিক কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ।
Ø শিশু অপহরন বা ব্যক্তি হরণের উদ্দেশ্যে আঘাত বা আক্রমণ।
Ø কোন ব্যক্তিকে অন্যায় বা বেআইনীভাবে আটক করার উদ্দেশ্যে হামলা হলে যে ক্ষেত্রে মুক্তির জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের আশ্রয় নিতে সমর্থন হবে না।
উপরোক্ত ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি তার নিজের বা অন্যর দেহ বা শরীর রক্ষার্থে আত্মরক্ষামূলক ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারেন। তবে শর্ত থাকে, যে ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির সরকারি কর্তৃপক্ষের (প্রশাসনের) আশ্রয় লাভের সুযোগ এবং সময় থাকে সেই ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলক ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। অর্থাৎ কেও যদি আপনাকে হুমকি দেয় আগামী ১ ঘণ্টা পর আপনাকে মেরে ফেলা হবে বা গুরুত্বর যখম করা হবে সেই খত্রে আপনি আপনার আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। কেননা আপনার হাতে ১ ঘন্টা সময় আছে প্রশাসনের সহায়তা নেয়ার জন্য।
আবার যে ক্ষেত্রে আপনার সুযোগ থাকছে ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগের সে ক্ষেত্রে আপনি কি পরিমান পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন নিজেকে রক্ষার্থে? ধরুন আপনাকে কেও বাঁশ দিয়ে আঘাত করতে চাইলে আপনি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে আপনাকেও বাশ বা সমজাতীয় লাঠি ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু কোন ভাবেই আপনি তার বিরুদ্ধে ধারালো কোন অস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন না।
শুধুমাত্র দেহ রক্ষার জন্য নয় বরং সম্পত্তি রক্ষার জন্যও একজন ব্যক্তি ৯৯ ধারার বিধিনিষেধ সাপেক্ষে মৃত্যু ঘটানোসহ শারীরিক ক্ষতি করা যেতে পারে যা অপরাধ বলে গণ্য হবে না (ধারা ১০৩) তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা আছে ১০৩ ধারাতে।
Ø দস্যুতা
Ø রাত্রিবেলা ঘর ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করা।
Ø কোন গৃহ, তাবু বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে ক্ষতি সাধন, যদি গৃহ, তাবু বা যানবাহনটি মানুষের বাসস্থান বা সম্পত্তি রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহিত হয় এবং
Ø চুরি, অনিষ্টকারিতা বা গৃহে অনধিকার প্রবেশ, যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ না করলে মৃত্যু বা গুরুতর আঘাত অনিবার্য।
একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র উপরোক্তন এই চারটি কারনে তার সম্পত্তি রক্ষার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত সংগঠিত করতে পারবে যা আইন অনুযায়ী কোন অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
আত্মরক্ষার অধিকার কখন শুরু হয় এবং কতক্ষণ পর্যন্ত এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন সে সম্পর্কে ধারা ১০২ ও ১০৫ তে বলা হয়েছে। ১০২ ধারা অনুযায়ী দেহের উপর এবং ১০৫ ধারা অনুসারে সম্পত্তির উপর ন্যায়সঙ্গত ভাবে বিপদের সম্ভবনার সাথে সাথেই একজন ব্যক্তির আত্মরক্ষা করার অধিকার জন্মায় বা শুরু হয়। যদি অপরাধটি সংগঠিত নাও হয় তবুও যতক্ষণ পর্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ভাবে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তি তার দেহ রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। মনে রাখা উচিত প্রাইভেট ডিফেন্সের বিধান রাখা হয়েছে অন্যায় আক্রমন থেকে নিজেকে রক্ষা করা। অন্যায় ভাবে কাওকে আঘাত করা না।
লেখকঃ সাজিদ মাহমুদ ভুইয়া
শিক্ষানবিশ আইনজীবী
ঢাকা জজ কোর্ট
ইমেইল- shajidmahmud@gmail.com