অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
আমরা সামাজিক জীব।সমাজবদ্ধ ভাবেই আমাদের বসবাস। সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনের উৎপত্তি ।আইন প্রনয়নকারীরা আইনসভায় বসে দেশের মানুষের কল্যান ও মঙ্গলের জন্য ভাল ভাল আইন প্রনয়ন করে থাকেন।সমাজকে সঠিক ও সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য আইন প্রনেতারা যথাসম্ভব সহজ ও সরলভাবেই সবার বোধগম্য আইন প্রনয়ন করে থাকেন। আইনসভার প্রনীত আইনকে ব্যাখ্যা করেন আইনজীবীরা। যে আইনজীবী যতবেশী বিজ্ঞ তাহার প্রদত্ত ব্যখ্যায় পরবর্তীতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রহনযোগ্যতা লাভ করে।বিজ্ঞতাই আইনজীবীদের প্রধান অস্ত্র।
একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর প্রধান কাজ হল সর্বদা মক্কেলের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আদালতকে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে সহায়তা করা।আইনজীবীরাও যেহেতু সমাজবদ্ধ মানুষ তাই সমাজের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান আইনজীবীগনকে করতে হয় । আইনজীবীগন নিজেদের প্রজ্ঞা ও আইনের সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে উদ্ভুত সমস্যার বাস্তবিক সমাধান করে থাকেন।সেজন্য আইনজীবীদের বিজ্ঞ বলা হয়। কি করে একজন বিচারপ্রার্থী বিজ্ঞ আইনজীবীর সহায়তায় চরম বিপদগ্রস্ত পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেয়ে যায় তারই একটি ঘটনা তুলে ধরছি।
আলম (ছদ্ননাম) ও সাইফুল ইসলাম (ছদ্ননাম) শশুর-জামাই সম্পর্কের।উভয়ের মধ্যে চলছে শত্রুতা। শশুর ও জামাই এর সে শত্রুতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে জামাই সাইফুল তাহার স্ত্রী আমেনা (ছদ্ননাম) কে হুশিয়ার করে বলে যে- আমার বিনা অনুমতিতে তুই যদি তোর বাপের বাড়িতে যাস,তাহলে আমার সাথে তোর বিবাহ তিন তালাক বাইন হয়ে যাবে“ উল্লেখ্য সাইফুল ইসলামের এই তালাকটি ছিল (Conditional Talak) শর্তসাপেক্ষ তালাক।
এই ঘটনার কিছু দিন পরে আমেনার পিতা আলম সাহেব হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরন করেন। পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমেনা স্বামী সাইফুলের অনুপস্থিতিতে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি রওয়ানা হয়ে যায় এবং বাপের বাড়ি পৌছানোর পুর্বেই বাপের দাফন কাফন সম্পন্ন হয়ে যায় এবং আমেনা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আবার স্বামী সাইফুল ইসলামের বাড়িতে ফিরে আসে।কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করেই সে বাধা প্রাপ্ত হয়। আশেপাশের প্রতিবেশী যারা সাইফুলের ঐ তালাকের কথা শুনেছিল তারা ইতোমধ্যে সারা গ্রামের লোকজনের কাছে প্রচার করে দিয়েছে যে সাইফুল বৌ তালাক দিয়েছে, তার বৌ তালাক হয়ে গেছে।ঐ বৌ নিয়ে এই গ্রামে সাইফুল আর সংসার করতে পারবেনা। সাইফুলের বৌ এখন হারাম হয়ে গেছে। হিল্যা করাতে হবে তা নাহলে এই বৌ আর বৈধ হবেনা। এই রকম পরিস্থিতিতে আমেনা আবার বাপের বাড়ির চলে যায় এবং ভাইদের সহিত বসবাস করতে থাকে। এদিকে স্বামী ব্যাচারির অবস্থা কাহিল। একদিকে সমাজ আর একদিকে রান্না-বান্নাসহ সংসারের সকল কাজ তাহাকে নিজ হাতে করতে হয়।সাইফুল তার ভুল বুঝত পারে। কবেকার এক কথার জন্য এই বয়সে বিয়ে করা বৌ বাড়িতে রাখতে পারবেনা এ কথা সে চিন্তাও করতে পারে না।ছেলে-মেয়েদের অবস্থা কি হবে ভেবে স্ত্রীর প্রতি সাইফুলের আরও ভালোবাসা বেড়ে যায়।সে স্ত্রীকে ফিরে পেতে চাই।
এই ঘটনা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কথায় কথায় সালিশ বসে,বচসা চলে মৌলভী মোল্লাদের মধ্যে । মৌলভী-মোল্লারাও দ্বিধা বিভক্ত বিষয়টি নিয়ে,কেই এ দলে কেউ বা অন্য দলে। একদল স্বামী সাইফুলের পক্ষে অন্যদল আইন ও সমাজ রক্ষার পক্ষে। হৈ হট্টোগোল চলতে থাকে।
অবশেষে বিচার বসে ইউনিয়নের মাঝখানে। সাইফুল ও আমেনাকে হাজির করা হয় উক্ত সালিশে। উভয় দলের লোকেরা উপস্থিত। উভয় দলের ফতোয়া, কাউন্টার ফতোয়া নিয়ে তর্কাতর্কি চরমে উঠে। এমন সময় উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় উভয়পক্ষের স্ম্মতিতে একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। অতঃপর একজন আইনজীবী শালিশি সভার মধ্যে প্রবেশ করিলে সালিশের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আইনজীবী কি বলেন বা কি সিদ্ধান্ত জানান সকলেই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন আইনজীবীর দিকে।
উপস্থিত লোকজনদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দেখে আইনজীবী প্রকৃত ঘটনা শুনলেন এবং সহজ সরলভাবে বললেন- সাইফুলের স্ত্রী আমেনা যখন তার পিতার বাড়িতে পৌঁছে ছিল তখন তার পিতা(আলম) জীবিত ছিলেন কি না? সকলেই উত্তর দিল যে, পিতার তখন মৃত্যু হয় এমনকি দাফন কাফনও হয়ে গিয়েছিল। তখন আইনজীবী বললেন যে- তাহলে স্বামীর পুর্বেকার (Conditional Talak) শর্তসাপেক্ষ তালাক বৈধ হয়নি। কারন পিতার মৃত্যু হওয়ায় ঐ বাড়ি আর তার পিতার ছিলনা” এ বাড়ির মালিক স্ত্রী আমেনা নিজেই। মুসলিম ফারায়েজ অনুযায়ী সে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ হিসেবে ঐ বাড়ির মালিক। আইনজীবীর আইনী ব্যাখ্যায় শালিশ বৈঠকের সকলে সন্তুষ্ট হলেন। স্বামী-স্ত্রী ব্যাচারিরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আইনজীবীর বিজ্ঞতার কারনে একটি কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান হলো। একটি পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল,সমাজ পেল সঠিক দিশা ।সেজন্যই আইনজীবীগণকে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়ে থাকে।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
কলামিস্ট ও আইনজীবী, জজকোর্ট মেহেরপুর
মোবাইলঃ ০১৭১৯-৪৭৭ ৫৫২