আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না। করোনা মোকাবিলায় দুই-চারটি নতুন প্রকল্প নেওয়া; গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এ খাতের দীর্ঘদিনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দূর করতে কাঠামোগত বড় সংস্কারের উদ্যোগ নেই। গতানুগতিকভাবেই স্বাস্থ্য বাজেট দেওয়া হচ্ছে।
করোনার কারণে স্বাস্থ্য বাজেট নিয়ে এবার বেশ আলোচনা হচ্ছে। ১৬-১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বছরে মাত্র ২৫ হাজার
কোটি টাকার মতো খরচ করে, যা বাজেটের ৫ শতাংশের কম। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ১ শতাংশের কম খরচ হয়। যা এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম।
আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ চলতি বছরের চেয়ে কমে যাচ্ছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে ১৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। আগামী এডিপিতে এই খাতে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। খরচ করতে না পারায় অবশ্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ১০ হাজার ১০৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
নতুন যা থাকছে
করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আড়াই হাজার কোটি টাকার দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অনুদানে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী সরাসরি কেনার কথা আছে। করোনাসংক্রান্ত প্রকল্প দুটি হলো বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকার কোভিড–১৯ ইমার্জেন্সি রেসপনস অ্যান্ড পেন্ডামিক প্রিপার্ডনেস প্রকল্প এবং এডিবির সহায়তায় ১ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার কোভিড–১৯ রেসপনস ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স প্রকল্প। প্রকল্প দুটি গত সপ্তাহে পাস হলেও টাকা খরচ শুরু হবে আগামী অর্থবছর থেকে। চলমান প্রকল্প হিসেবে আগামী এডিপিতে যুক্ত হয়েছে। সব জেলা হাসপাতালে আইসোলেশন সেন্টার বা সংঘ নির্মাণ এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ইউনিট তৈরিই প্রকল্প দুটির মূল উদ্দেশ্য। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীও কেনা হবে। এ ছাড়া আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গবেষণার জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। জনবলসংকট কমাতে ইতিমধ্যে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অবকাঠামোতেই আগ্রহ
এবার দেখা যাক, এডিপিতে কেমন প্রকল্প আছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে মোট ৬৭টি বিনিয়োগ প্রকল্প আছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৩১টি প্রকল্প। সার্বিকভাবে এডিপিতে থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৪৮টি প্রকল্পই হাসপাতাল ভবন, মেডিকেল কলেজ ভবন, নার্সিং ইনস্টিটিউট ভবনের মতো অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প। বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণের তিনটি প্রকল্প এবং একটি যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্প আছে। গবেষণা, প্রশিক্ষণ—এমন দক্ষতা বৃদ্ধির আলাদা কোনো প্রকল্প নেই। তবে কিছু প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে প্রশিক্ষণ এবং সীমিত পরিসরে গবেষণার সুযোগ রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ৯টি প্রকল্প ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার আধুনিকায়ন; জিডিপির ভিত্তিবছর পরিবর্তনের জন্য সমীক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ পরিসংখ্যান শক্তিশালী করার মতো প্রকল্পও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে। আদমশুমারি ও প্রতিবন্ধী জরিপের প্রকল্পও স্বাস্থ্য খাতে অন্তর্ভুক্ত।
স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম বড় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের একটি হলো ৪৩ হাজার কোটি টাকার চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি। আগামী অর্থবছরে এই কর্মসূচিতে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ছোট-বড় ২৯ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, এডিপির মাধ্যমে মানসম্পন্ন খরচ হয় না। আর স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তাদের অবকাঠামো খাতেই খরচের আগ্রহ বেশি। কারণ এতে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি।
১০ বছরে বরাদ্দ তিন গুণ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটকেই সাধারণত স্বাস্থ্য বাজেট হিসেবে ধরা হয়। উন্নয়ন ও পরিচালন—এই দুই খাতের খরচ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট তৈরি হয়। বেতন–ভাতা, সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ কেনা, নিয়মিত যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মতো অবধারিত খরচ মেটানো হয় পরিচালন ব্যয় থেকে। উন্নয়ন বাজেট দিয়ে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনসহ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, প্রশিক্ষণ, সচেতনা বৃদ্ধি, গবেষণা—এসব কাজ হয়।
গত ১০ বছরে বাজেটের আকার যে হারে বেড়েছে, সেই হারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়েনি। এ সময়ে মন্ত্রণালয়টির বাজেট বেড়েছে তিন গুণ। বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় সোয়া চার গুণ। ফলে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অংশীদারত্ব ক্রমশ কমেছে। বাজেট ঘোষণার সময় খাতওয়ারি বরাদ্দ ১৫টি ভাগে ভাগ করা হয়। দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাত বাজেটের ৬ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছিল। ১৫টি খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান ছিল নবম। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ নেমেছে বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ৯ শতাংশে। স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান ১১তম।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা সংকটে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর চিত্র ওঠে এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করায় ধনীরা উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন। অন্যদিকে গরিবদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাই সর্বজনীন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আগামী কয়েক বছরে স্বাস্থ্য খাতের খরচ জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
টাকার অঙ্কে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১ হাজার ৮৭১ জনের বিপরীতে আছেন একজন চিকিৎসক। এ ছাড়া প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে নার্সের অনুপাত ২ দশমিক ৯৯ এবং সরকারি হাসপাতালে শয্যার অনুপাত ২ দশমিক ৮৯।
অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাস্থ্য খাতের অসংগতিগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। আগামী অর্থবছরে করোনা মোকাবিলায় বেশি নজর দিতে হবে। তবে সার্বিকভাবে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে, যা এক দিনে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। আগামী অর্থবছর থেকেই তা শুরু করা উচিত।
এপিএস/০৬জুন /পিটিআই/এনএস