নাঈম শাহারিয়ার
যেখানেই শোষণ আর বঞ্চনা সেখানেই নজরুলের বিদ্রোহ, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর—‘বিদ্রোহী কবি’ ‘বিদ্রোহী কবি’ নামেই তাই বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান । দেশ ও কালের আহ্ববানকে উপেক্ষা করে নয়, দেশ কালের আবিলতায় প্রোথিত থেকেই শাশ্বতের বাণী উচ্চারণ করেছেন নজরুল। তাঁর লেখার জাদু স্পর্শে মুগ্ধ পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর বাঙালি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে। * জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন(১৮৯৯-১৯২০): ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে(১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিঁনি। তার পিতা কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন।
মাত্র ৯ (১৯০৮সালে) বছর বয়সে কবি তার পিতাকে হারান। বাল্যকালেই তার ডাক নাম ছিলো দুখু মিয়া। মাত্র ১০ বছর বয়সেই জীবিকার জন্য তাকে কাজে নামতে হয়। স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন কবি। কিন্তু এই কাজে তিনি বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো দলে যোগ দেন। এখানেই তার সাহিত্য চর্চার শুরু। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে পূণরায় ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। কিন্তু আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়।
রুটি রোজীর জন্য তাকে আসানসোলের রুটির দোকানে কাজে যোগদান করতে হয়। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৭-২০ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই অবস্থান করেন।
*মধ্য_জীবন: (১৯২০-৪২): সেনাবাহিনী থেকে ফিরার পর সাংবাদিক হিসেবে যোগদান। নজরুল সম্পাদিত পত্রিকা- ১. ধূমকেতু (১৯২২); এই পত্রিকাতেই নজরুল প্রথম ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ২ লাঙল(১৯২৫); বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণিসচেতন পত্রিকা। নজরুলের দীপ্তবেগে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯২২ সালে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ কবিতায় তিনি ১৪টি ছোট বড় স্তবকে এবং ১৪১ পঙিক্ততে ব্রিটিশ ভারতীয়দের বীর হিসেবে সম্বোধন করে জেগে উঠতে আহ্বান করেন, ‘বল বীর বল চির উন্নত মম শির।’
বইটিতে বিদ্রোহীর আগুন-ঝরা অংশে ছিল, “মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।” এ কবিতার মাধ্যমে তিনি অন্যায়, অবিচার ও পরাধীনতার শৃঙ্খলা থেকে মুক্তির ডাক দেন। তাঁর ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনের অধিকাংশ সময়ে ব্রিটিশ রাজরোষের শিকার হন। নয় বছরে (১৯২২-১৯৩১) তাঁর পাঁচটি বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে তিনি দুবার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। প্রথমবার এক বছরের জন্য জেল খাটেন ১৯২৩ সালে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার জন্য। অন্যটি ১৯৩০ সালে প্রকাশিত ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য।
১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই তিনি দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন। *নজরুলের যা কিছু প্রথম: -প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা, ১৯১৯সালে প্রকাশিত) -প্রথম গল্প ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’(সওগাত, ১৯১৯সালে প্রকাশিত) -প্রথম উপন্যাস ‘বাধন হারা'(মোসলেম ভারত, ১৯২০সালে প্রকাশিত) -প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ব্যাথার দান'(১৯২২) -প্রথম কাব্য ‘অগ্নিবীণা'(১৯২২) বাজেয়াপ্ত গ্রন্থ সমূহ: .যুগবাণী(১৯২২) .বিষের বাঁশী (১৯২৪) .ভাঙার গান (১৯২৪) .প্রলয় শিখা (১৯৩০) .চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) *নিষ্প্রাণ_জীবন(১৯৪২-৭৬): এই দীর্ঘ ৩৪টি বছর কবির এক অসহনীয় নির্বাক জীবনকাল অতিবাহিত হয়। এরমধ্যে ১৯৭২ সালের ২৪মে তৎকালীন সরকার কবিকে স্সপরিবারে ঢাকায় আনয়ন করেন।
১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২২শে জুলাই কবির সাস্থের অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। দীর্ঘ এক বছর এক মাস আট দিন পিজি হাসপাতালে অবস্থানের পর ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করা হয়।
লেখকঃ নাঈম শাহরিয়ার। আইন বিভাগ, বাউবি।