অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন বলতে কি বোঝায়? What is Specific Performance?
কোন চুক্তি ভঙ্গ হলে ইংল্যান্ডের সাধারণ আইনে চুক্তিভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের ডিক্রি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।কিন্তু চুক্তিভঙ্গকারীকে চুক্তি মোতাবেক সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদনে বাধ্য করার কোন ব্যবস্থা ছিল না ।ইংল্যান্ডের Equity আদালতের চ্যান্সেলারগণ যখন দেখলেন যে অনেক ক্ষেত্রে চুক্তিভঙ্গের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতি অর্থের দ্বারা পূরণের প্রতিকার পর্যাপ্ত বিবেচিত হয়না; এমতাবস্থায় চ্যান্সেলারগণ কতিপয় বিশেষ চুক্তিভঙ্গকারীকে চুক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করার আদেশ দিতেন। সংক্ষেপে ইহাকেই চুক্তি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন বলা হয়(Specific Performance)। এভাবে সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের Equity আদালতে যে সব বিধানাবলীর সৃষ্টি হয়,সেগুলি পরবর্তীতে এই উপমহাদেশে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে (Specific Relief Act) বিধিবদ্ধ হয়।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকারঃ (Specific Relief)
আমাদের বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার (Specific Relief) বলতে ঐ সকল প্রতিকারকে বোঝায় যা কোন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বিধান মোতাবেক সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়ার অধিকারী। ১৯০৮ সালের সিভিল প্রসিডিউর কোডের আওতায় দেওয়ানি মোকদ্দমায় যে সাধারণ প্রতিকার দেওয়া হয় তা হল ক্ষতিপূরণের অধিকার। কিন্তু সাধারণ অধিকার হিসেবে ক্ষতিপূরণের অধিকার অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে না।এ কারণেই সাধারণ প্রতিকারের বিপরীতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের উদ্ভব হয়েছে।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের ধরণ ও প্রকারভেদঃ (Nature of Specific Relief and its Classification)
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার মূলতঃ দুই ধরণের হতে পারে। (ক)প্রতিকার সম্বন্ধীয় (Remedial Nature) এবং (খ) রক্ষামূলক বা বাধ্যতামূলক (Mandatory and Preventive Nature) প্রতিকার সম্বন্ধীয় প্রতিকার যেমন- কোন দখল পুনরুদ্ধার Recovery of Possession, চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন (Specific Performance of Contract), পার্থক্যকরণ (Variation) , সংশোধন (Rectification), রদকরণ (Rescission), নাকচ বা বাতিলকরণ (Cancellation), ঘোষণামূলক ডিক্রী (Declaration Decree) ও রিসিভার নিয়োগ (Appoint of Receiver ইত্যাদি। অন্যদিকে রক্ষামূলক (Preventive) বা বাধ্যতামূলক(mandatory) প্রতিকারের মধ্যে আছে নিষেধাজ্ঞা (Injunction)।নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আবার আছে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা (Permanent Injunction, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা (Temporary Injunction ও অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা (Ad-interim Injunction) ইত্যাদি
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার কিভাবে প্রদান করা হয়ঃ
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫ ধারা মোতাবেক নিম্নলিখিত পাঁচভাবে এ প্রতিকার প্রদান করা হয়।
(১) কতিপয় সম্পত্তির দখল গ্রহণ এবং উহার দাবিদারকে দখল অর্পণের মাধ্যমে;
(২) কোন বিশেষ কার্য সম্পাদনে বাধ্য এমন ব্যক্তিকে এ বিশেষ কার্যটি সম্পন্ন করবার জন্য নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে;
(৩) কোন বিশেষ কার্য সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য এমন কোন ব্যক্তিকে উক্ত কার্য সম্পাদনে বিরত রাখার মাধ্যমে;
(৪) ক্ষতিপূরণের রায় প্রদানের মাধ্যম ব্যতীত অন্য কোন প্রকারে পক্ষসমূহের অধিকার নির্নয় এবং ঘোষণার মাধ্যমে; অথবা
(৫) একজন রিসিভার নিয়োগের মাধ্যমে।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার কখন দেয়া যায় নাঃ
দেওয়ানি মোকদ্দমায় সাধারণ প্রতিকার তথা ক্ষতিপূরণের প্রতিকারের বিপরীতে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার ব্যবহৃত হয়। এই প্রতিকার সমূহ কেউ অধিকারবলে দাবী করতে পারবেন না; ইহা আদালতের ইচ্ছার(discretion) উপর নির্ভর করে থাকে।১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, শুধুমাত্র দন্ডমূলক আইন কার্যকরী করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার প্রদান করা যাবে না।
কোন কোন চুক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করা যায়ঃ
এই প্রসঙ্গে যাবতীয় আইন ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা থেকে ২০ ধারা পর্যন্ত বিবৃত আছে।
১২ ধারাঃ নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে কার্যকর করা যেতে পারে-
(ক) যখন চুক্তিভূক্ত কার্য সম্পাদন পুরোপুরি বা অংশত একটি জিম্মার অন্তর্ভুক্ত।
(খ) যখন চুক্তিভূক্ত কার্য সম্পাদন না করিলে যে ক্ষতি হইবে তাহা নির্ণয় করার কোন মান দন্ড থাকে না।
(গ) যখন চুক্তিভূক্ত কার্যটি এমন হয় যে তাহা না করিলে আর্থিক ক্ষতি পূরণের মাধ্যমে পর্যাপ্ত প্রতিকার পাওয়া যায় না।
(ঘ) যখন এই সম্ভাবনা থাকে যে, চুক্তিভূক্ত কার্য সম্পাদন না করার জন্য আর্থিক ক্ষতি পূরণ পাওয়া যাইবে না।
উল্লেখ্য এই ধারা প্রথম দিকে বলা আছে চুক্তি মোতাবেক চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদনের আদেশ দেওয়া আদালতের ইচ্ছাধীন (Discretionary)। আদালতের ইচ্ছা সর্বদাই (Judicial Discretion) কোন অবস্থাতেই আদালতের স্বেচ্ছাচারী নহে। আদালতের ইচ্ছা সর্বদাই যুক্তিযুক্ত,ন্যায়ভিত্তিক(Equitable) এবং অত্র আইনে বর্ণিত নির্দেশাবলীর অনুকূল হইতে হইবে।
চলবে———–
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, মেহেরপুর।, E-mail:mizanmpur06@gmail.com